শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৭ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় শিগগিরই

সাঈদীর পূর্ণাঙ্গ রায় শিগগিরই

deloar-hosen2_101079আমার সুরমা ডটকম : একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় শিগগিরই প্রকাশিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালত। প্রায় এক বছর পর এখন ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রায় পেলে সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে রাষ্ট্রপক্ষ। আর অভিযোগ থেকে খালাস দিতে পুনর্বিবেচনার আবেদন হবে সাঈদীর পক্ষ থেকেও। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার দপ্তর বলছে, সাঈদীর ওই রায় লেখা এখন শেষ পর্যায়ে। খুব শিগগিরই তা প্রকাশ হবে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি  চেয়ে ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন করা হবে।

অপরদিকে সাঈদীর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রায় প্রকাশিত হলে অভিযোগ থেকে সাঈদীর খালাস চেয়ে পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ।
বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন: বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। দুই বিচারপতি অবসরে চলে যাওয়ায় তারা এ মামলার পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন না।

তাই নতুন করে রিভিউ শুনানির জন্য নতুন বেঞ্চ করতে হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী যে বিচারপতি আপিল বিভাগের রায় দেন, তিনি রিভিউ আবেদনের শুনানি করেন। কিন্তু দুই বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর তারা রিভিউ শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন না। নতুন করে পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করতে হবে।’
রায় থেকে জানা যায়, আপিল বিভাগের বিচারপতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। এর মধ্যে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেন। এ ছাড়া বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্যদিকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন। রায়ে পাঁচটি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে সাঈদীকে দণ্ড দেওয়া হয়। এরমধ্যে একাত্তর সালে তিন নারীকে অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণ এবং কয়েকজন ব্যক্তিকে জোর করে ধর্মান্তরিত করার ঘটনায় জড়িত থাকাসহ তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাঈদীকে স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে সরকার ও আসামিপক্ষ উভয়েই বলেছে, রায়ে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় প্রথম তিন দিনেই ৭০ জন নিহত হন। এই মামলায় আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আপিলের ওপর ৫০ দিনের মতো শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়। এগুলো হচ্ছে-৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ। এরমধ্যে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
রায়ে বলা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর করা ফৌজদারি আপিল ও সরকারের ফৌজদারি আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হলো। ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হলো। অষ্টম অভিযোগের একটি অংশ থেকে তাকে খালাস এবং অপর অংশে দণ্ড পরিবর্তন করে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। সপ্তম অভিযোগে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হলো। সাজা ও খালাসের সব সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে নেওয়া হয়।
তিন অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ড: ১০ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল পিরোজপুরের উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন দেয়। পরে সাঈদীর ইন্ধনে বিসাবালিকে নারিকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। ১৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের একটি বাড়ি থেকে তিন বোনকে ধরে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। এই অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও ট্রাইব্যুনাল কোনো সাজা দেননি। আপিল বিভাগ এই অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। ১৯ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, সাঈদী জোর করে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেন। এই অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও ট্রাইব্যুনাল কোনো সাজা দেননি। আপিল বিভাগ এই অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন।
দুটিতে দুই মেয়াদে কারাদণ্ড: ৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৮ মে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে নুরুল ইসলাম খানকে আওয়ামী লীগার এবং তাঁর ছেলে শহীদুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেন। পরে তাঁদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই অপরাধে ট্রাইব্যুনাল তাকে কোনো দণ্ড দেননি। তবে আপিল বিভাগ সাঈদীকে এই অপরাধে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। ৮ নম্বর অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭১ সালের ৮ মে সাঈদী ও তাঁর দলের সদস্যরা চিথোলিয়া গ্রামের মানিক পশারির গ্রাম লুট করেন। সেখান থেকে মানিক পশারির ভাই মফিজুদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যান। পাঁচটি ঘরে আগুন দেন। সেনাক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার সময় সাঈদীর প্ররোচনায় পাকিস্তানি সেনারা ইব্রাহিমকে হত্যা করে। মফিজকে সেনাক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ এই অভিযোগের অংশবিশেষ থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন। বাকি অভিযোগের জন্য মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
তিন অভিযোগে খালাস: রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ৬, ১১ ও ১৪এই তিন অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়। ৬ নম্বর অভিযোগ হচ্ছে, পারেরহাট বাজারের আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকান লুট করা। ১১ নম্বর অভিযোগ ছিল, পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে গিয়ে টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে নির্যাতন এবং বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
১৪ নম্বর অভিযোগ ছিল, ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী নিয়ে গিয়ে হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় কয়েকজনকে ধর্ষণ করা এবং পাড়ায় আগুন দেওয়া। এই তিন অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ট্রাইব্যুনাল সাঈদীকে কোনো সাজা দেননি। আপিল বিভাগ রায়ে তাকে তিনটি অভিযোগ থেকেই খালাস দেন। এই রায় প্রকাশের পর সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সাঈদীর বিরুদ্ধে করা মামলাটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা। রায় পর্যালোচনা করে এর বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হবে। এখনো বিশ্বাস করি, আসামি ন্যায়বিচার পাবেন।’ রায়ে সংক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট জানিয়ে সাঈদীর অপর আইনজীবী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে।
সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, ‘রায়ে সন্তুষ্ট নই। আমরা প্রত্যাশিত ন্যায়বিচার পাইনি। আশা করেছিলাম তিনি খালাস পাবেন। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর পুনর্বিবেচনার আবেদন করব।’ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদী গ্রেপ্তার হন। ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২৮ মার্চ দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com