রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ অপরাহ্ন
“ঈমান-আকীদা রক্ষার কাজে জমিয়তিরা সামনে থাকবে কেনো?” “মিটিং-বৈঠকে তারা কেনো সবসময় সর্বাগ্রে থাকবে?”
আমার সুরমা ডটকম ডেক্স: দীর্ঘদিন ধরে এরকম নানা অযাচিত প্রশ্ন দেখি আর আপত্তি উত্থাপনকারীর জানাশোনার পরিধি দেখে মুচকি হেসে এড়িয়ে যাই৷ প্রত্যেকে স্বাধীন, সবার মুখ আছে, যা খুশী তা বলতে পারে৷ কিন্তু ইসলাম-মুসলমান আর দেশজাতির গুরুত্বপূর্ণ সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টির অসদুদ্দেশ্যে যখন বারবার এমন কথা বলা হয়, গত সাড়ে চারদশকে জমিয়তের অবদান এবং ভূমিকা সংক্ষেপে হলেও সামনে আসা প্রয়োজন মনে করছি৷
ক, ১৯৭১-এর মার্চে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর প্রাক্কালে অল পাকিস্তান জমিয়ত সেক্রেটারী মুফতী মাহমুদ রহ জুলফিকার ভুট্টোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এবং তার হুমকির থোড়াই কেয়ার করে ঢাকায় এসে বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ের নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান সাথে দেখা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আওয়ামীলীগের সরকার গঠনের দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান৷ তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত নেতৃবৃন্দকে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সম্পৃক্ত থাকার মেসেজ দিয়ে যান৷ জমিয়ত নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার পক্ষে প্রকাশ্য এবং গোপনে ভূমিকা রাখেনও৷ একাজে উৎসাহ যোগায় জমিয়তের আধ্যাত্মিক রাহবার, হিন্দুল্তান জমিয়ত সভাপতি ফিদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানী রহ কর্তৃক সীমান্তের ওপারে শরণার্থী শিবির স্থাপন করে কয়েক হাজার বাঙ্গালীর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালনের ঘটনাটি৷ স্বাধীন বাংলাদেশে সবধরনের ধর্মীয় রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হলেও জমিয়ত দ্বীনি সংগঠন হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়৷ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বন্ধ ঘোষিত কওমী মাদরাসাগুলো পুনরায় চালু করণে জমিয়ত নেতৃবৃন্দের সরাসরি ভূমিকা ছিলো৷ এর নেপথ্যে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে স্বাধীনতার স্বপক্ষে তাদের ইতিবাচক তৎপরতা৷
খ, ১৯৭৮ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কাদিয়ানীদের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিবেন জানতে পেরে তৎকালীন জমিয়ত সেক্রেটারী মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামছুদ্দিন কাসেমী রহ-এর নেতৃত্বে জমিয়ত নেতৃবৃন্দ তার সাথে সাক্ষাত করে সম্মেলনে না যেতে অনুরোধ করেন৷ আলহামদুলিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে সেই সম্মেলনে যাবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন৷
গ, ‘বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক’ নামে ঢাকা কেন্দ্রীক বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত সর্বপ্রথম জমিয়তের রাজনৈতিক রেজুলেশনে গৃহিত হয়৷ অতঃপর তৎকালীন আকাবির উলামাদের সমন্বয়ে যা বাস্তব রূপ লাভ করে৷ যার উপদেষ্টা ছিলেন খলীফায়ে মাদানী হজরতুল আল্লামা আব্দুল করীম রহ শায়খে কৌড়িয়া (যিনি ইতোপূর্বে এবং পরে কেন্দ্রীয় জমিয়ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন), প্রথম সভাপতি পটিয়ার হজরত হাজী ইউনুস সাহেব রহ, প্রথম সেক্রেটারী তৎকালীন জমিয়ত সভাপতি শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ৷ এভাবেই সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার শীর্ষ আলেমদের সমন্বয়ে বেফাক গঠিত হয়৷ যা আজ সারাদেশে সর্ববৃহৎ বোর্ড হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে৷ বলাইবাহুল্য বেফাককে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত জমিয়ত নেতৃবৃন্দের ভূমিকা সর্বাগ্রে৷ এই সময়ে বিভিন্ন জেলার বড় বড় মাদরাসার মুহতামিম, শায়খুল হাদীস সাহেবদের অধিকাংশের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে৷
ঘ, ১৯৮১ সালে জমিয়ত তার সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রেখে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ-এর নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলনের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করণে সক্রিয় এবং জোরদার তৎপরতা চালায়৷
ঙ, ১৯৮৬ সালে গুলিস্তানে গোলাপশাহ মাজার ঠিক রেখে মসজিদ উঠিয়ে দিতে চাইলে এর প্রতিবাদে সংঘটিত আন্দোলনে সামনে সারিতে থাকার কারণে তৎকালীন জমিয়ত সেক্রেটারী মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ কারাবরণ করেন এবং তার একান্ত সহচর ও বর্তমান কেন্দ্রীয় জমিয়ত সহ-সভাপতি কারী আব্দুল খালিক আসআদী সাহেব পুলিশের বেয়নেট চার্জে রাজপথে রক্ত ঝরান৷
চ, ১৯৯১ সালে ওলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ব্যানারের প্রয়োজনে ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ গঠনে জমিয়ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে৷ যার চূড়ান্ত মিটিং জমিয়তের অন্যতম মারকাজ জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো৷
ছ, ১৯৯৩ সালে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে দানা বেধে ওঠা আন্দোলন জোরদার করণে জমিয়ত নেতৃত্বাধীন ‘খতমে নবুওয়ত আন্দোলন পরিষদ’ বন্ধ রেখে আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের সাথে সমন্বিত কার্যক্রম চালায়৷
জ, পরের বছর নাস্তিক-মুরতাদ, এনজিও, জনকণ্ঠ ও তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ এবং ‘ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও’ শীর্ষক আন্দোলনে জমিয়তের ভূমিকা ছিলো সামনের সারিতেই৷
ঝ, ২০০০ সালে ফতোয়াবিরোধী রায় বাতিলের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিশেষত শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ এবং মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ-এর কারামুক্তির দাবীতে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে জমিয়ত অগ্রণী ভূ্মিকা পালন করে৷
২০১১ সালে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আহুত হরতাল কর্মসূচীতে শাহাদত বরণ করেন যশোর মণিরামপুর মাদানীনগর শাখা ছাত্র জমিয়ত কর্মী হাফেজ হোসাইন আহমদ৷ কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে এক সাথে গ্রেফতার হন ৪৪ জন জমিয়ত নেতাকর্মী৷
ঞ, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম-এর নেতৃত্বে সারাদেশে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনে কেন্দ্রীয় হেফাজত ছাড়াও মহানগর এবং জেলা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ২০টি জেলার মূল নেতৃত্বে ছিলেন জমিয়তের দায়িত্বশীলগণ৷ হেফাজতের আন্দোলন পরবর্তী বিভিন্ন মামলায় কারবরণ করেন তৎকালীন জমিয়ত মহাসচিব ও বর্তমান নির্বাহী সভাপতি মুফতী মুহাম্মদ ওয়াককাস এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র জমিয়তের সাবেক সভাপতি মুফতী শরীফুল ইসলাম৷ এছাড়াও কেন্দ্রীয় ও জেলা এবং থানা পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীই জেলজুলুম সহ্য করেন৷ এ দেশের ইতিহাসে হাফেজ্জী হুজুর রহ, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ, খতীব আল্লামা উবায়দুল হক রহ, চরমোনাইর পীরসাহেব মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ, মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ প্রমুখের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ কিন্তু যারা নিরবে, নেপথ্যে থেকে ইসলামী শিক্ষা ও আকীদা-বিশ্বাস সংরক্ষণ এবং বাতিলের মোকাবেলায় আপোসহীন ভূ্মিকা পালন করেছেন আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া রহ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ, মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ, হজরত শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রহ প্রমুখ জাতির আদর্শিক রাহবার এবং এই সময়ে তাদের স্বার্থক উত্তরসূরী মুফতী মুহাম্মদ ওয়াককাস সাহেব, আল্লামা নূর হেসাইন কাসেমী সাহেব কিংবা সিলেটের আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি অথবা আজাদ দ্বীনি এদারার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা শায়খ জিয়াউদ্দীন সাহেবদের অবদান এবং অবস্থান কওমী অঙ্গনের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউই অস্বীকার করতে পারেন না৷
এখন কেউ যদি না জেনে যদি বিরূপ মন্তব্য করেন সেটা তার সুবিবেচনার পরিচায়ক হবেনা৷ আর রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে যদি অনলাইন পোর্টাল অথবা স্বনাম/বেনামী আইডি থেকে জমিয়ত নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি আর সক্রিয়তা নিয়ে কুৎসা রটান, প্রশ্ন ওঠান, তবে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, এই আপত্তি স্রেফ রাজনৈতিক ইর্ষার কারণেই হচ্ছে৷ আমরা তাদের শুভবুদ্ধির উদয় কামনায় দোয়া করি৷ আর রাজনৈতিক ভিন্নমতের বিদ্বেষকে যদি দ্বীনি শিক্ষা সংরক্ষণ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে টেনে আনেন, তো আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, ইনশাআল্লাহ কারো ইর্ষাকাতরতা অথবা হীন প্রচারণায় আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন থেকে পিছপা হবোনা৷
লেখাটি ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ‘ওমর ফারুক’-এর ফেইসবুক আইডি থেকে নেয়া।-সম্পাদক: আমার সুরমা ডটকম