মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:১৬ অপরাহ্ন
আবু সাঈদ রাউফী:
“হাজার বছর বাচতে ইচ্ছে হয়….
প্রভু দয়াময়,
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায়না এ মন
তবু চলে যেতে হয়!”
আবদুর রাহমান আমার ছোট ভাই। তাকে নিয়ে কিছু লিখব ভাবতেই বুকটা ধড়পড় করে উঠে। কাঁদতে ইচ্ছে হয় হাউমাউ করে। বড় ভাইয়ের আগে ছোট ভাইয়ের প্রয়াণ এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায়না। মেনে নিতে কষ্ট হয়। মুরব্বীরা বলেন-আসার সিরিয়াল আছে, যাওয়ার সিরিয়াল নাই। আসলেই তাই। আল্লাহ পাকের অকাট্য বাণী-কুল্লু নাফসিন যা ইক্বাতুল মাউত” প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। হ্যা, এটাই চির সত্য ধ্রুব সত্য। কেউ আগে কেউ পরে এ দুনিয়া ছেড়ে একদিন চলে যেতেই হবে।
বাবা মরহুম আব্দুর রউফ মারা গেলেন ঊনিশ শ নব্বই সালের অক্টোবরে। আবদুর রাহমান তখন ক্লাস নাইনে। আমাকেই তখন পরিবারের হাল ধরতে হয়। লেখাপড়ার ডোর বেশী দূর এগোলো না। মাঝপথে হোচট খেলাম। মনে মনে ভাবলাম ভাইকে পড়াবো। আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তাকে একটা অবস্থানে পৌছাবো ইনশা আল্লাহ।
১৯৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি জন্ম নেওয়া আবদুর রাহমানের সেই থেকে পথ চলা। নিজ গ্রাম খুজগীপুরের প্রাইমারী থেকে পাঠশালা শেষ করে ১৯৯২ সালে জাফরাবাদ হাইস্কুল থেকে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এস এস সি পাস করে ভর্তি হয় সিলেট সরকারী কলেজে। ১৯৯৪ সালে পাস করে এইচ এস সি। অতঃপর মদনমোহন কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স ও ১৯৯৮ সালে মাষ্টার্স কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করে। ২০০২ সালে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে কোম্পানিগন্জ এম সাইফুর রহমান ডিগ্রী কলেজে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে এ দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করে। ১৯৯৭ সাল থেকে আমার চাচা সাংবাদিক সেলিম আউয়াল সাহেবের সহযোগীতায় সাংবাদিকতার সাথে জড়িয়ে পড়ে দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকায় কাজ করার মাধ্যমে। এরপর সিলেটের বহুল প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক এ বেশ কিছুদিন কাজ করে। একজন সৎ নিষ্টাবান যোগ্য ও দক্ষ সাংবাদিক হিসেবে সিলেটের সাংবাদিক মহলে তার সুনাম ছড়াতে থাকে। যার সুবাদে সিলেটের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের নজরে পড়ে আবদুর রাহমান।
ডাক পড়ে দৈনিক সিলেট প্রতিদিন’ দৈনিক প্রভাতবেলা’ ও মাসিক ভিলেজ ডাইজেস্ট’ কাজ করবার। প্রিয়ভাজন হতে থাকে বিশিষ্ট সাংবাদিকদের। একপর্যায়ে সদস্য হওয়ার সুযোগ পায় “সিলেট প্রেসক্লাব” এর। সিনিয়র সাংবাদিক জনাব আহমাদ নূর-এর সহযোগিতায় ঢাকার জাতীয় পত্রিকা দৈনিক কালের কন্ঠ এর প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে সিলেট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে যোগদান করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকার সিলেট প্রতিনিধির দায়িত্বও পালন করে আমৃত্যু। পত্রিকার পাশাপাশি আবদুর রাহমান সিলেট বেতারেও বেশ কিছুদিন কাজ করে। সাংবাদিকতার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে অভিজ্ঞতার দরকার। সেই তাগিদে আবদুর রাহমান বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনে ট্রেনিং দিয়ে কৃতকার্যের সার্টিফিকেট ও এওয়ার্ড অর্জন করে।
“বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল” “নিউজ নেটওয়ার্ক” “প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (pib)” “বাংলাদেশ মানবাদিকার সাংবাদিক ফোরাম (bmsf)” “ডেমোক্রেস” প্রভৃতি সংগঠন আবদুর রাহমানকে সফল সাংবাদিক হিসেবে সনদ ও এওয়ার্ড প্রদান করে।
একদিন কথা প্রসঙ্গে আবদুর রাহমান আমাকে বলল ভাইছাব, আমার পাশের চেয়ারে বসা সহকর্মী তিনজনই লন্ডন চলে গেছে। এবার আমার পালা। আমি বললাম-এটা কি করে সম্ভব? আমাদের তো আপন কেউ লন্ডনে নেই। তাছাড়া প্রচুর টাকার দরকার। আবদুর রাহমান বলল-দুআ করুন। আল্লাহ চাইলে একটা ব্যবস্থা অবশ্যই হবে।
মাসেক দিন চলে গেল। লন্ডনের ভিসার প্রসেসিং চলছে। এমন সময় সিলেটের জগন্নাথপুরের বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডের মিষ্টার আনোয়ার চৌধুরী বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে ঢাকায় আসেন। আবদুর রাহমান এই রিপোর্টটি ফলাও করে পত্রিকায় লিখে যা সরেজমিন রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়। শেষে এক পর্যায়ে আবদুর রাহমান আনোয়ার চৌধুরীর বাসায় গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করে এবং একসাথে ফটোও তোলে। পরবর্তীতে তার লন্ডনের ভিসা তুলতে এগুলো বেশ সহায়ক হয়।
জগন্নাথপুরের কৃতিসন্তান লন্ডনের সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকার ভাইস চেয়ারম্যান, জগন্নাথপুর ব্রিটিশ-বাংলা এডুকেশন ট্রাস্ট’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব আলহাজ্ব এমএ আহাদ-এর স্পন্সরে, এবং লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাব এর দীর্ঘ সময়ের সভাপতি, লন্ডনের সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকার সম্পাদক মহিব চৌধুরীর সার্বিক সহযোগিতায় ও ভিলেজ ডাইজেস্ট পত্রিকার সম্পাদক জনাব রাগিব হোসেন চৌধিরীর অনুপ্রেরণায় আবদুর রাহমান ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ড সফরে যায়। ওখানে তাকে রিসিভ করে তার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্দু লন্ডন প্রবাসী রোমান খান, রোমানের স্ত্রী মৌরী খান, রোমানের ফুফাতো বোন মমতা বেগম ও সাংবাদিক মোহাম্মদ জোবায়ের প্রমুখ।
পাচ মাসের সফর শেষে দেশে ফিরে আবদুর রাহমান। ইচ্ছে করলে সে অবৈধভাবে লন্ডনে থাকতে পারতো কিন্তু তার সে লোভ নেই। অবৈধ উপায়ে এক পয়সাও সে খেতে চাইতো না। এ অভ্যাস তার ছোটকাল থেকেই ছিল এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার উপর অটল ছিল। ইংল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আবদুর রাহমান ২০১৪ সালের মার্চে একটি বই প্রকাশ করে। “বিলেতের গ্রামে” নামের এই বইটি খুব পাঠক প্রিয়তা পায়। অল্প দিনের মধ্যে প্রকাশিত বই এর প্রায় সত্তর ভাগ কপি বিলি হয়ে যায়।
আবদুর রাহমান গ্রামের ছেলে। তাই সে গ্রামকে খুব ভালবাসে। বেশীর ভাগ রচনা তার গ্রামকে নিয়েই। ইংল্যান্ডে গিয়েও সে গ্রামের কথা ভুলতে পারেনি। সময়ে সুযোগে খোজখবর নিয়েছে ইংল্যান্ডের সবুজ শ্যামল গ্রামগুলোর। আর সেই চিত্রগুলোই তুলে ধরেছে তার বই-এ।
আবদুর রাহমান বইখানা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল-ভাইছাব, আপনি আমাকে জীবনে অনেক দিয়েছেন, আমি শুধু আপনাকে এই বইখানা দিলাম। বইখানা হাতে নিয়ে খুশিতে আমার চোখদুটু অশ্রুসজল হয়ে গেলো। বললাম-আল্লাহ পাক তোমার এ দানকে কবুল করুন। লেখালেখির জগতে আবদুর রাহমান একজন স্পষ্টভাষী লেখক হিসেবে পরিচিত। সত্য প্রকাশে তার কলমের নিভ ছিল অত্যন্ত ধারালো। বড়সাহেব ছোটসাহেব এসবের তোয়াক্কা সে কখনও করতো না। তার বেশ কটি প্রবন্ধ পাঠকদের মধ্যে খুব সাড়া জাগিয়েছে। ন্যায়নীতি ও সত্যের পক্ষে তার কলম ছিল সদা সোচ্চার।
তার সম্পাদনায় (যৌথ) বেরিয়েছে সিলেটের প্রথম শপিং গাইড “কেনাকাটা” (দুই সংখ্যা) যা ব্যবসায়ী ও কাষ্ঠমারের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়তে সক্ষম হয়েছে। তার সম্পাদিত সিলেটের প্রথম মেডিকেল ডাইরেক্টরী “হ্যালো ডাক্তার” বইখানাও পাঠকদের দারুণ নজর কেড়েছে। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি স্হানীয় খাগদিওর গ্রামের মরহুম মুনীর চৌধুরী সাহেবের তৃতীয়া কন্যা সাজমিন বেগম চৌধুরীকে বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করে আবদুর রাহমান। ২০১২ সালের ১১ জুলাই তার একমাত্র মেয়ে “মাহবুবা ফাইজা” জন্ম নেয়। আল্লাহ পাক মেয়েটির নেক হায়াত দরাজ করুন।
আবদুর রাহমান অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিল। প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করতে কখনও কার্পণ্য করতো না। আমার ছেলে “হাসান”কে নিয়ে খুব বড় স্বপ্ন দেখতো।আদর করতো নিজের ছেলের মত। আমাকে বলতো-ভাইছাব, কটা দিন কষ্ট করুন। দেখি আল্লাহ কি করে। ভাতিজাকে ইউরোপের কোন দেশে পাঠিয়ে দিবো। আর কুদ্দুসকে বড় একটা দোকান দিয়ে দিবো। আমাদের দিন বদলে যাবে।
আবদুর রাহমান শহরে থাকলেও গ্রাম ও এলাকার প্রতি তার ভীষণ টান ছিল। তাই সমমনা বন্দুবান্দবদের নিয়ে এলাকায় একাধিক সমাজকল্যাণমুলক সংগঠন গঠন করে তোলে। “পশ্চিম গৌরীপুর স্টুডেনস ফোরাম”, “পশ্চিম গৌরীপুর ডেভেলপমেন্ট ফোরাম” প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নিজ গ্রাম খুজগীপুরে আমরা কজনের উদ্যোগে গঠন করেছিলাম “খুজগীপুর তাওহীদী সংঘ”, “পানজেরী পাঠাগার”, “আলমদীনা সমাজকল্যাণ সংস্থা”, “উচ্ছ্বাস সাহিত্য পরিষদ”। আবদুর রাহমান এইসব সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিল।
২০১৫ সালের শেষদিকে আবদুর রাহমান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। পেঠফাপা বমি। এন্ডোসকপি টেষ্টের মাধ্যমে খাদ্যনালীতে ধরা পড়ল টিউমার। আর এই টিউমার থেকেই জন্ম নিল মরণব্যাধি ক্যানসার! ঢাকার গ্যাস্টোলিভার হাসপাতালে ডাক্তার মুহাম্মদ আলী স্যারের তত্ত্ববাধানে সফল অপারেশন হল কিন্তু ক্যানসারের জন্য নিতে হল দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা “কেমো থেরাপী”। ৬টি থেরাপী দেওয়ার পরও কোন উন্নতি না হওয়ায় পাঠানো হল ভারতে কোলকাতা ক্যানসার হাসপাতালে। কিন্তু তাতেও কোন সুফল হল না। শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানতে হল তাকে।
২৫ জুলাই ২০১৬ সোমবার বিকেল ৪ ঘটিকায় সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবদুর রাহমান দুনিয়ার মায়াজাল ছিন্ন করে পরপারে পাড়ি জমায়। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে মা দুই ভাই এক বোন স্ত্রী এক মেয়ে সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন গুনগ্রাহী সহকর্মী বন্দুবান্দব রেখে গেছে। তার মৃত্যুতে সিলেটে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশেষ করে সাংবাদিক পাড়ায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দেশের জাতীয় পত্রিকাসহ স্হানীয় সব পত্রিকায় ফলাও করে তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিদেশের বাংলা পত্রিকায় ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া টিভি চ্যানেল, অনলাইন, ফেসবুক, টুইটার, লন্ডনের চ্যানেল এস, বাংলা টিভিতেও আবদুর রাহমানের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়।
বাড়িতে এসে সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং মা সফরুন নেছাকে সান্তনা দেন সিলেট প্রেসক্লাবের সম্মানীত নেতৃবৃন্দ, কোম্পানিগন্জ এম সাইফুর রহমান ডিগ্রী কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
২৬ জুলাই সকাল ১০ ঘটিকায় আবদুর রাহমানের প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয় সিলেট প্রেসক্লাব চত্বরে। বিকেল আড়াইটায় তার গ্রামের বাড়ি বালাগন্জের পশ্চিম গৌরীপুর ইউনিয়নের খুজগীপুর গ্রামে দ্বিতীয় জানাযার পর তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাপন করা হয়। আল্লাহ পাক আমার ভাই আবদুর রাহমানকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।
লেখক: মরহুমের বড় ভাই, প্রভাষক সাংবাদিক আবদুর রাহমান-এর ১ম মৃত্যুবার্ষিকী ২৫ জুলাই ২০১৭ উপলক্ষে স্মৃতিচারণ।