বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৬ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি: ড. মোমেন

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি: ড. মোমেন

আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক: এনআরবি নিউজ, নিউইয়র্ক থেকে:  মিয়ানমারের চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানে অবিলম্বে সামরিক অভিযান বন্ধ, ত্রাণ-কর্মীদের মিয়ানমারে প্রবেশাধিকার এবং নিজ এলাকায় নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদার সাথে প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা প্রদানের আহবান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। একইসাথে, এহেন পরিস্থিতির মূল কারণ উদঘাটনের পর তা চিরতরে নির্মূলের কথাও বলেছেন মহাসচিব। তাহলেই রাখাইনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

২৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে নিরাপত্তা পরিষদের সভায় উদ্বোধনী বক্তব্যে মহাসচিব এন্তোনিয়ো গুতিরেজ ৫ লক্ষাধিক শরনার্থীকে আশ্রয় প্রদানের জন্যে বাংলাদেশের সাহসের প্রশংসা করেন এবং শরনার্থীদের খাদ্য-ওষুধসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রি প্রদানকারিদের প্রতিও গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। মহাসচিব ক্যাটাগরিকেলি বলেছেন যে, রাখাইনের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জাতিগত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে মহাসচিব উল্লেখ করেছেন, ‘বিরাট একটি জনগোষ্ঠিকে বছরের পর বছর ধরে যদি অধিকারবঞ্চিত রাখার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তার পরিণতি কখনো শুভ হতে পারে না, অধিকন্তু বঞ্চিতরা চরমপন্থা অবলম্বনে বাধ্য হতে পারে, যা সকলের জন্যেই ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরী করবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক মাসের মধ্যে চারবার আলোচনার আয়োজন করায় নিরাপত্তা পরিষদকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মহাসচিব।
তিনি বলেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের উপর যে সহিংসতা হয়েছে তা মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হতে পারে এবং সেখানে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতার মুখে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠক হলো। এটাই আট বছরে মিয়ানমার নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম উন্মুক্ত বৈঠক।

গুতেরেস বলেন, রাখাইনে সহিংসতা রোহিঙ্গাদের খুব দ্রুতই বিশ্বের বড় উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে, যা মানবিকতা ও মানবাধিকারের জন্য ‘দুঃস্বপ্নের’ জন্ম দিয়েছে।
“পালিয়ে আসা, যাদের বেশিরভাগ নারী, শিশু ও বয়স্ক, তাদের কাছ থেকে আমরা রক্ত হিম করা বক্তব্য পেয়েছি।
“তাদের বর্ণনায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, বেসামরিকদের বিরুদ্ধে ভূমি মাইন ব্যবহার ও যৌন সহিংসতাসহ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকারের গুরুতর লংঘনের কথা বলে।”

রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে গত ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের সহিংসতার মুখে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া না মেলার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, মিশর, সেনেগাল ও কাজাখস্তানের অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদ এদিন বৈঠকে বসে।
রাখাইনে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে অবিলম্বে ত্রাণ সংস্থাগুলোকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন গুতেরেস। জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বর্তমান অবস্থানে উদ্বেগ জানিয়েছেন তিনি।
এই সংকটের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোসহ পুরো অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক অসন্তোষের ঝুঁকি দেখা দেওয়ার বিষয়েও সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহসাচিব।
হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, দশকের পর দশক শোষণ-বৈষম্যের শিকার হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে চরমপন্থার উত্থান ঘটতে পারে।
মহাসচিব বলেন, মাত্র একদিন আগেই জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনার রোহিঙ্গা শরনার্শীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছেন। দুই সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বখাদ্য সংস্থা, মানবাধিকার সম্পর্কিত সমন্বয় অফিস, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এবং ইউনিসেফের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সমান্ত এলাকা সফর করবেন। ৯ অক্টোবর ইউএন এইচ সি আর, উচাহ এবং অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে দাতা সংস্থাগুলোর সভা হবে।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে মহাসচিব বলেন, সে সময় আমি তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি বিরাটসংখ্যক শরনার্থীর সাথে মানবিক আচরণের জন্যে। প্রাণ ভয়ে সন্ত্রস্ত শরনার্থীদের নিরাপত্তা এবং খাদ্য-আশ্রয় প্রদানে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। একইসাথে শরনার্থীদের জন্যে যারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

রাখাইন পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলি।
মিয়ানমার পরিস্থিতির আলোকে এই সভায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ছাড়াও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য উপস্থাপন করেন। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও স্টেট কাউন্সেলরের বিশেষ দূত ইউ থাঙ্গ্ তুন (ট ঞযধঁহম ঞঁহ) রাখাইনের ভয়াবহতার জন্যে আল ক্বায়েদা এবং অভ্যন্তরীণ একটি সন্ত্রাসী গ্রুপকে দায়ী করেন। সাথে বাংলাদেশের একটি মহলের মদদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি দাবি করেন, ‘মিয়ানমার সরকার তার দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে বদ্ধপরিকর। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমঅধিকার ভোগ করছে মিয়ানমারে। তিনি অস্বীকার করেন যে, রাখাইনের মুসলমানেরা বর্বরোচিত আচরণের অতীষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাড়ি-ঘর ছেড়েছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সুপারিশ অনুযায়ী মিয়ানমার সরকার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সাথে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবসহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদেরকে রাখাইনে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বলেও উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যের পরই বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বক্তব্য দেন। মোমেন বলেন, ‘সারাবিশ্ব অবলোকন করছে রাখাইনের পরিস্থিতি। তাই মিথ্যাচার করে সত্য লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করেই সমাধানের পথে এগুতে হবে বলে রাষ্ট্রদূত মাসুদ সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘৫ সেপ্টেম্বরের পর রাখাইনে আর কোন বর্বরতা চলেনি বলে মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন তাও সর্বৈব মিথ্যা। কারণ, গতকালও ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে প্রতিদিনই শত সহ¯্র রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মিডিয়ার লোকজন ইতিমধ্যেই জানতে সক্ষম হয়েছেন যে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর হাতে বহু নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। ধর্ষণের ভয়ে অনেকে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় ২০০ গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে রাখাইনে।
নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ছিলেন সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে এ মোমেন তিনি সভা শেষে মিডিয়াকে জানান,রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি ছিল। ‘১৫ সদস্যের ১৩জনই স্পষ্টভাষায় মিয়ানমারের সমালোচনা করেছে। রাশিয়া এবং চীনের বক্তব্য ছিল অস্পষ্ট। এটিই দুশ্চিন্তার কারণ। এমন একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি, যা সারাবিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, মানবিক বিপর্যয় চরমে উঠেছে, অথচ চীন আর রাশিয়া যেভাবে সোচ্চার হওয়া উচিত, সেটি দেখলাম না।’ মোমেন বলেন, ‘মিয়ানমারের বক্তব্যে অসত্য তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে, যা কারোরই কাম্য ছিল না। কারণ, এখন প্রায় সকলেই জেনে গেছেন মিয়ানমার সরকারের বর্বরোচিত আচরণের কথা।’
রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন উল্লেখ করেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের এ সভায় প্রায় সকল বক্তাই উদ্ভ’ত পরিস্থিতির অবসানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উত্থাপিত ৫ দফা কর্মসূচির আলোকপাত করেছেন অর্থাৎ ঐ প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি মিয়ানমারে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র বিক্রি বন্ধের আহবান জানিয়েছেন।
সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত। তার বক্তব্যে শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি ঘটেছে। তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন মিয়ানমার প্রশাসনের। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ১ অক্টোবর থেকে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবে ফ্রান্স। সে কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত এ সভায় বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের সাথে একাত্ম হয়ে আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করবো না।’ রোহিঙ্গাদের এমন মানবেতর পরিস্থিতিকে মেনে নেয়া যায় না। সভ্য সমাজের প্রতিটি সদস্যের উচিত হচ্ছে এহেন বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। যদিও সকল বক্তাই পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে উদ্ভ’ত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ অবসানের পরামর্শ দিয়েছেন।
নিরাপত্তা পরিষদের ৭টি সদস্যরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সেনেগাল, মিশর, সুইডেন, ফ্রান্স ও কাজাখস্তান জাতিসংঘ মহাসচিবকে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতির উপর নিরাপত্তা পরিষদে এই বিবৃতি প্রদানের অনুরোধ জানায়। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতির পর নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্যরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধিগণ বক্তব্য রাখেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com