বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৭ অপরাহ্ন
অধ্যক্ষ সৈয়দ রেজওয়ান আহমদ:
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশ দীর্ঘ ৯ (নয়) মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ‘জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের’। বিবেকবান কোনো মানুষ কখনও জালিমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে কথা বলা এটাই মনুষত্বের পরিচয় এবং ঈমানী দায়িত্ব। আর সে ঈমানী দায়িত্ব পালনার্থেই আলেম সমাজ এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানি জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করতে স্বচেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। রাজপথে যুদ্ধ করেছেন। কাজ করেছেন দেশপ্রেমিক হয়ে। অসংখ্য উলামায়ে কেরাম তাদের জান-মাল ও সর্বশক্তি দিয়ে এ দেশের মজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আবার অনেকেই পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে অবদান রেখেছিলেন। নিচে স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের মধ্যে অন্যতম কয়েকজনের অবদান উল্লেখ করা গেল।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী:
যাকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার মুল স্বপ্নদ্রষ্টা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্য ইতিহাস দৃশ্যপটে আনলে আমরা এমন এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই, তিনি হলেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাষানীর শিক্ষক সিরাজগঞ্জ মাদরাসার প্রধান মাওলানা আব্দুল বাকী উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ মাদরাসায় পাঠিয়ে দেন। ওখানে দুই বছর অবস্থানকালে তিনি মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সাহচর্যে শাহ ওয়ালীউল্লাহর রাজনৈতিক চিন্থাধারার সাথে পরিচিত হন। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় মাওলানা ভাষানী তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি না দিলে দেশে ফরাসী বিপ্লব করার হুমকি দান।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ:
আমরা স্মরণ করতে পারি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এর কথা। যিনি মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯২৩ সালে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হয়ে এক বছর অধ্যয়ন করেন। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়া একজন আলেম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন বিজ্ঞ সংগঠক ও যোদ্ধা।
তাঁর সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ লিখেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মাওলানা তর্কবাগীশ উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখেন। তিনি ওলামা পার্টি” গঠণ করে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন এই পার্টির সভাপতি। মাওলানা তর্কবাগীশ ভাষা অন্দোলনের সময় নিরীহ বাঙালীর বুকে পশ্চিম পাকিস্তান হায়েনাদের রক্তাক্ত পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম গণপরিষদে বাংলায় বক্তৃতা করেন এবং বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করেন।
মাওলানা শামছুল হুদা পাঁচবাগী:
যিনি প্রকাশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে থাকেন এবং এ ভুখণ্ডের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন। আলেম সমাজ যে শুধু যুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছেন তা নয়, বরং ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে চলে যাওয়ার সময় যখন নেতারা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রাপ্তির সাফল্যে সন্তুষ্ট, তখন একজন আলেম পূর্ব-পশ্চিমের এ সংযুক্ত বিভাগকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি হলেন মাওলানা মুহাম্মদ শামছুল হুদা পাঁচবাগী। যিনি পাকিস্তান প্রস্তাব (১৯৪৩)-বিরোধী এবং স্বাধীন বাংলার প্রবক্তা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি মৌলভী আবুল হাশেম, বেঙ্গল কংগ্রেস পার্লমেন্টারি পার্টির নেতা কিরণ শংকর রায় প্রমুখ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তোলেন। কিন্তু সেই দাবি কংগ্রেসের সমর্থন লাভ করেনি এবং গোটা বাংলা-আসামকে পাকিস্তানভুক্ত করার যে দাবি মুসলিম লীগের ছিল, তাও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট মেনে নেয়নি। হাশেম-সোহরাওয়ার্দী এবং কিরণ শংকরের স্বাধীন বাংলার দাবির বেশ আগেই মাওলানা পাঁচবাগী তাঁর প্রচারপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা কায়েমের দাবি পেশ করেছিলেন। এ নিরিখে তাঁকে বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার সর্বপ্রথম দাবিদার বা স্বপ্নদ্রষ্টা বলা চলে।
১৯৭০-৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সময় মাওলানা পাঁচবাগী মুক্তিকামী জনগণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেন। পাকবাহিনীর হাত থেকে অনেকের জীবন রক্ষা করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি তাঁর বাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। গফরগাঁও এবং কিশোরগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে এখনও যা কিংবদন্তি হয়ে আছে।
শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান:
এ দেশের বহু আলেম-ওলামা যখন পাকিস্তান ও ইসলামকে একীভূত করে দেখেছিলেন আর পূর্বপাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে এদেশ থেকে ইসলামনিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বলে ভাবতে ব্যতিভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক সে মুহূর্তে অসংখ্য আলেম-ওলামার মধ্য থেকে বের হয়ে এসে বীরবিক্রমে তিনি স্বাধীনতার ও স্বাধিকারের স্বপক্ষে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনিই একমাত্র আলেম, যিনি শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা বই লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। অমর বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান যিনি ছিলেন ধর্মমন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই প্রথম ষাটের দশকে স্বতন্ত্র ধর্মদপ্তর একটি জাতীয় প্রয়োজনই লিখে বহুকাঙ্খিত স্বপ্নের জানান দেন।
শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান হিংস্র হানাদারদের হাতে বন্দি হবার কদিন আগে ছন্দ এঁকেছিলেন এভাবে-
‘আমায় তোরা দিস গো ফেলে হেলা ভরে পথের ধারে,
হয়তো পথিক করবে দোয়া দেখবে যখন কবরটাকে।’
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী তালিকায়মাওলানা অলিউর রহমানের নাম থাকলেও (১৯৭২ সালে প্রণীত) মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে বুদ্ধিজীবী নামের তালিকায় তাঁর নাম নেই। একটাই কারণ তিনি ছিলেন একজন আলেম।
মুফতী আমীমুল ইহসান:
যিনি ১৯৭১ সালে মুফতী আমীমুল ইহসান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফতওয়া দিয়েছিলেন। ফলে ইয়াহিয়া সরকার তাঁকে জোর করে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর:
বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুযুর্গ মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রাহ.) সে সময়ে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন -‘‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফুরের যুদ্ধ নয়, এটা জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ- পাকিস্তানিরা জালেম। এ দেশের নিরীহ মানুষ ছিল মজলুম। সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ জালেমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তার পক্ষে কথা বলা এটাই বিবেকের দাবি।’’
মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী:
যিনি সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি বলেন ‘‘আমি তখন হাফেজ্জী হুজুর এবং শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হকের ছাত্র, লালবাগে পড়ি, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বড় ছাত্ররা হাফেজ্জী হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ভুমিকা কী হতে পারে এই যুদ্ধে? হুজুর বললেন- অবশ্যই জালেমদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম-আমি কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারবো? হুজুরবললেন –‘অবশ্যইযেতে পার’। অত:পর আমি গেরিলা প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে যাই এবং যুদ্ধে অংশ নিই।’’ এতে প্রতীয়মান হয় সামর্থ্যের আলোকে সকলকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হাফেজ্জী হুজুরের মত একজন বড় আলেমের যথাসাধ্য সহযোগিতা ছিল।
মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী ও মাওলানা আব্দুল্লাহ জালালাবাদী:
মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী বলেন, সারাদেশে টালমহাল অবস্থা ৬ দফাকে কেন্দ্র করে। ফুঁসে উঠেছে চারদিক ৬দফার সমর্থনে। তখন এদেশে কতিপয় ধর্মীয় দল, আলেম-ওলামা ৬ দফার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগেন। প্রচারণা শুরু করেন এই বলে যে, ৬দফা কর্মসূচী ইসলাম পরিপন্থী, জাতীয় ঐক্য ও সংহতিবিরোধী ইত্যাদি। এমনি সময় বঙ্গবন্ধু এলেন সিলেটে। দেখা হলো, পরিচয় হলো মাওলানা উবায়দুল্লাহ জালালাবাদী সাথে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঢাকায় গেলে দেখা করার কথা বলেন। মাওলানা উবায়দুল্লাহ বলেন, ‘আমি ঢাকায় এসে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বঙাগবন্ধুর সাথে দেখা করি। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ৬ দফায় ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু আছে কী-না? প্রতিউত্তরে আমি বললাম, আপনি ৬ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির দাবি জানিয়েছেন, এটা ইসলামের পরিপন্থী তো নয়ই বরং সহায়ক। তখন থেকে আমি নিজেকে এগিয়ে নিলেন ময়দানে। গড়ে তুলার চেষ্টায় লিপ্ত হলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আলেমদের জনমত। নিজেকে জড়িয়ে দিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের মহান আন্দোলনে। কখনো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, কখনো মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গনী উসমানীকে যুদ্ধকালীনসঙ্গ দিয়ে।’
বল যায়, স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখেছেন মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। তাঁরই অগ্রজ মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী সময়, মেধা, ও শ্রম দিয়ে সাহায্য করেছেন ছোট ভাইউবায়দুল্লাহকে, জীবন বাজী রেখে পক্ষ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের। অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের উপলক্ষ্য হয়েছেন স্বাধীনতাপ্রেমী এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানের।
মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন স্ঈাদ জালালাবাদী:
মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন স্ঈাদ জালালাবাদী বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, পাকিস্তান আসলে কোন ইসলামী রাষ্ট্র নয়। আমি নিজ থেকে স্বভাবসুলভভাবে অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলাম পাকিস্তান আমাদের কোনো উপকারে আসবে না। না এতে ইসলামের উপকার হবে, না আমরা রক্ষা পাব। মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি, যিনি প্রথম ঢাকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়ান, তিনি এবং মাওলানা শাবিক্ষর আহমদ উসমানিসহ প্রখ্যাত আলেমদের সঙ্গে জিন্নাহ’র ওয়াদা ছিল পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হবে। তারা আমাদের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমরা কেন সেই রাষ্ট্র রক্ষা করব। এসব জিজ্ঞাসার প্রতি-জিজ্ঞাসা মাঝে আমার ছোট ভাই উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আমারই শিক্ষক মাওলানা অলিউর রহমানকে প্রধান করে ‘আওয়ামী ওলামা পার্টি’ গঠন করে। আমি ওস্তাদের সঙ্গে দেখা করে আশ্বাস ও সাহস যুগিয়ে যাই এই বলে, আপনি এগিয়ে যান, আমি আপনাকে সাহায্য করে যাব পেছন থেকে” মুক্তিযুদ্ধ সময়ের দিনগুলোর কথা বললেন আব্দুুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী।
আলেমদের বর্ণিত ত্যাগ-তিতীক্ষা স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। এমনই আরও কিছু উদাহারণ নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করব এবং প্রমাল করব যে, এদেশের আলেম সমাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশপ্রেমের ভালবাসা দেখিয়ে নিজেদের আত্মত্যাগ করেছেন।
(অসমাপপ্ত)