রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৪৮ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার : দিরাইয়ের পল্লীতে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সে গ্রামে চলছে তাণ্ডবলীলা, প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে আক্রমণ করে ঘরের আসবাবপত্র, কাপড়-ছোপড়, স্বর্ণ ও নগদ টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে পুরুষ শূণ্য গ্রামে নারী ও শিশুরা রয়েছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। শুক্রবার গ্রাম ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কাজাউড়া গ্রামে। দিরাই থানা পুলিশ ও গ্রামবাসির সূত্রে জানা যায়, গত ৮ অক্টোবর গ্রামের সাবেক মেম্বার আনোয়ার হোসেন ও বর্তমান মেম্বার মুনসুর আলীর লোকজনের মধ্যে হাওরের একটি ডোবা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা চলে আসছে। ডোবা থেকে অর্জিত টাকা ক্যাশিয়ারের কাছে রাখাকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য শালিসে গত কয়েক দিন আগে একটি সংঘর্ষ হয়। পরে এ নিয়ে গত ৯ অক্টোবর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে একটি শালিস বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৮ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টায় গ্রামের উত্তরে অবস্থিত নোয়াপাড়া থেকে দক্ষিণের কাজাউড়া গ্রামের আসার পথে মুনসুর আলীর লোক গিয়াস উদ্দিন (২৭) ও তার স্ত্রী লিলুফা বিবি (২২) ওপর আক্রমণ করে আনোয়ার হোসেনের লোকজন বলে জানা যায়। গুরুতর আহত স্বামী-স্ত্রীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে লিলুফা মারা যায়। এ ঘটনা শোনার পরই নিহতের আত্মীয়-স্বজনরা ক্ষিপ্ত হয়ে শনিবার সকালে কয়েক দফায় দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের লোকজনের বাড়িঘরে আক্রমণ করে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। বর্তমানে আনোয়ার হোসেনের পক্ষের লোকজনের বাড়িতে কোন পুরুষ সদস্য না থাকায় তারা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পুনরায় হামলা করার আশংকায় আতংকে রয়েছেন। যে কোন সময় আবরো দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে তাদের লোকজনের জানমাল ও ইজ্জত হরণ করতে পারে বলে জানিয়েছেন একাধিক নারী। এ ব্যাপারে তারা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতাও চেয়েছেন।
এদিকে এ ঘটনার খবর পেয়ে দিরাই থানার এসআই মহাদেব বাচার নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থল কাজাউড়ায় গেলে পরিস্থিতি শান্ত হলেও তারা চলে আসার পর আবারো হামলার আশংকা রয়েছে বলে বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এসআই মহাদেব বাচা এ প্রতিবেদককে জানান, খবর পাওয়ার সাথে সাথেই আমরা চলে আসি এবং এখানের অবস্থা বর্তমানে শান্ত রয়েছে। ভাঙচুরের ঘটনার কথা স্বীকার করে তিনি জানান, সামান্য ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ আসেনি এবং কেউ গ্রেফতারও হয়নি। দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ বায়েছ আলম জানান, ঘটনার খবর পাওয়ার পরই আমি পুলিশ পাঠিয়েছি, বর্তমানে সেখানের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে এবং পুনরায় হামলার কোন আশংকা নেই। কোন অভিযোগ এখন পর্যন্ত আসেনি এবং কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
অন্যদিকে নিহত অন্ত:স্বত্ত্বা লিলুফা বিবির লাশ ময়না তদন্ত শেষে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। শনিবার বাদ আছর নামাজে জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার স্বামী গিয়াস উদ্দিন গুরুতর আহতাবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে এবং জান্নাত বেগম নামে এক বছরে একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।
সরেজমিন কেজাউড়া গিয়ে দেখা গেছে এক ভূতুরে পরিবেশ, দিনদুপুরে দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ হায়েনাদের মতো বাড়িঘরে আক্রমণ করলে দিশেহারা হয়ে পড়েন পুরুষ শূণ্য ঘরে থাকা নারী ও শিশুরা। তারা জানালেন এক ভীতিকর পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা। জানা যায়, শুধুমাত্র আনোয়ার হোসেনের লোক হওয়ার কারণে গ্রামের মধ্যস্থানে অবস্থিত আব্দুল গফফার মিয়ার একটি রাইসমিল ভাঙচুর করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। এতে তার প্রায় ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। একইভাবে পল্লী চিকিৎসক সৈয়দুর রহমানের বাড়িতে থাকা ফার্মেসী ও ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর, নগদ ৩০ হাজার টাকা ও তার স্ত্রীর ৩ ভড়ি স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নেয়াসহ প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান পরিবারের লোকজন।
কেজাউড়া গ্রামের সাবেক মেম্বার আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী রাজিয়া বেগম জানান, দুপুর সাড়ে ১১টায় প্রতিপক্ষের প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা আমার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এছাড়া ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর, কাপড়-ছোপড়, নগদ টাকাসহ সর্বমোট প্রায় ৪ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলেও জানান তিনি। তাছাড়া যাওয়ার সময় আবারো হামলার হুমকি দেয় প্রতিপক্ষের লোকজন। তিনি আরো জানান, হামলার সময় মৃত আহমদ আলীর ছেলে এলাছ মিয়া (৩৫), মৃত আমান উল্লার ছেলে আব্দুল কুদ্দুছ সরকার (৪৮), মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে বর্তমান মেম্বার মুনসুর আলী (৩২), মৃত সাজিদ আলীর ছেলে আব্দুল মনির (৫২), মৃত মহিম উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিনসহ ৫০-৬০ জন নারী-পুরুষ হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে অংশ নেয়।
এদিকে গ্রামের মৃত আবু মিয়ার ছেলে আব্দুল জেহাদের বাড়িতে হামলা করে প্রায় ১ লাখ টাকার ক্ষতি করেছে বলে জানা গেছে। মৃত শের আলীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মাতবর আলী, মাহমদ আলী ও আনফর আলীর বাড়িতে হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুর, ঘরের গোলায় থাকা দেড়শত মণ ধান লুটপাট ও কয়েকটি গরু ছিনিয়ে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষের লোকজন বলে জানান তারা। মৃত আনফর আলীর ছেলে জমসের আলী ও তার ছেলে রফিকুল মিয়ার বাড়িতেও হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও সরেজমিন দেখা গেছে। তাছাড়া আব্দুল খালিকের একটি দোকান ঘরও ভাঙচুর করে দোকানের মালামাল নিয়ে যায় বর্তমান মেম্বার মুনসুর আলীর লোকজন। এতে তার প্রায় দেড় লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়েছে বলে জানান তিনি।
গ্রামের নিরপেক্ষ কয়েকজনের সাথে আলাপকালে তারা এ প্রতিবেদককে জানান, মূলত সংঘর্ষের কোন ঘটনা এ দিন ঘটেনি, সম্ভবত দীর্ঘদিনের গ্রাম্য কোন্দলকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই তারা নিজেরা এ কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনাস্থলের আশপাশের অনেকেই এই মন্তব্য করেছেন।