বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২৮ পূর্বাহ্ন
মোঃ মিজানুর রহমান:
দিরাই-শাল্লাসহ সুনামগঞ্জের অনেকেই আমাকে ২০ শয্যার এই হাসপাতালটি কিভাবে প্রতিষ্ঠা করলাম, কেন চালু হচ্ছে না বা কিভাবে চালু করা যাবে সে বিষয়ে প্রায়ই জানতে চান। তাদের কৌতূহল নিবারনের জন্য এই লেখা।
যুক্তরাজ্য থেকে লেখাপড়া শেষ করে ২০০৩ সনের জুলাই মাসে দেশে ফিরে উপ-সচিব হিসাবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগদান করি। এলাকার প্রতি আমার দরদ গ্রামের মানুষজন জানতেন। তাদের ধারনা হল এবার আমি আমার গ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারবো। কোন একদিন আমার কাছে আসলেন আমার গ্রামের শ্রদ্ধাভাজন চাচা জনাব আব্দুল মতিন ও আব্দুল ওয়াদুদ মানিক (এখন প্রয়াত) এবং এক ছোট ভাই বদরুল হুসেন। তারা আমাকে গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষের কথা শুনতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি গেলাম এবং দিরাই থেকে জগদল পর্যন্ত সকল গ্রামের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হলাম আর তাদের দাবি দাওয়ার সাথে পরিচিত হলাম। অবশ্য দাবীগুলির কিছু আমি এলাকার সন্তান হিসাবে আগে থেকেই জানতাম।
দাবি অনুযায়ী আমি একে একে আমার প্রতিশ্রæত জগদল গ্রামের ভিতরের প্রায় ৩ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ, জগদল আল-ফারুক হাইস্কুলের জন্য অতিরিক্ত দুটি ভবন নির্মাণ, ৩ তলা জগদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, দ্বিতল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, রাজনগর (হালায়া) গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, বাশুরি গ্রাম বিদ্যুতায়ন, জগদলে তহশিল অফিস ভবন নির্মাণ এবং টুকদিরাই থেকে করিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পাকা সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করি। কৃষি ব্যাংকের একটি শাখা জগদলে প্রতিষ্ঠা করেও অদৃশ্য কারণে তা রাখতে পারিনি। প্রতিশ্রæতি মোতাবেক হাতিয়া গ্রামের বিদ্যুতায়নের অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করলেও সরকার পরিবর্তনের কারণে কাজটি সমাপ্ত করতে পারিনি। করিমপুর থেকে মাটিয়াপুর গ্রামের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত অনুমোদিত প্রকল্পের ১ কিলোমিটার শেষ করার পর আর অগ্রসর হতে পারি নাই এবং সরকার পরিবর্তনে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। একইভাবে দিরাই বালিকা বিদ্যালয় থেকে কালনি নদীর উপর একটি ব্রিজ আমি অনুমোদন করিয়েছিলাম যার টেন্ডার ও হয়েছিল কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সাথে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে দিরাই-মদনপুর রাস্তা সস্প্রসারণ কিভাবে করলাম সে কাহিনী পরে একদিন বলা হবে।
এভাবে একের পর এক উন্নয়ন কাজ যখন করে যাচ্ছিলাম, এলাকাবাসির দাবি ও আকাঙ্খা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। ক্রমবর্ধমান আকাঙ্খার প্রতিফলন হিসাবে একদিন আমার প্রয়াত চাচা আব্দুল অদুদ মানিক এবং ভাই বদরুল হুসেন আমার কাছে আরও দুটি দাবি উথাপন করলেন। এর একটি হল জগদলে থানা আর অপরটি জগদলে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। থানার বিষয়ে আমি নীতিগতভাবে একমত ছিলাম না, কিন্তু হাসপাতালের দাবি শুনে আমার মন কাতর হয়ে পড়ে।
মনে পড়ে যায়, আমার মা ও বাবার প্রায় বিনা চিকিতসায় মৃত্যুর দুবিসহ স্মৃতি। মা ও বাবার চেয়ে আপন জন দুনিয়াতে আর কেউ নাই। আমার মা ডায়াবেটিকসহ নানান জটিল রোগে ভুগছিলেন। প্রায়শই মাকে নিয়ে দিরাই ডাক্তারের কাছে যেতে হতো। মনে পড়ে, কার্ত্তিক মাসে ঝাঁপির (পলো) মধ্যে খড় বিছিয়ে মাকে দিরাই হাসপাতালে নিতে হতো। কারণ, এই সময় নৌকা চলতনা হাটাই ছিল একমাত্র যোগাযোগ। পলোর ঝাঁকুনিতে মা মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতেন আমিও কাঁদতাম। ১৯৮৫ সনে মাকে যখন সিলেট নিয়ে যাই তখন মা ছিলেন সব চিকিৎসার উর্ধ্বে। আমরা মাকে হারাই। এখনও মায়ের সেসব স্মৃতি মনে হলে কান্না থামতে চায় না। হাসপাতাল না থাকা এবং যোগাযোগ বঞ্চনার কারণে প্রায় একইভাবে ২০০৬ সনে বাবাকেও হারাতে হয়।
হাসপাতালের প্রস্তাব আসাতে মনে হল এইতো সুযোগ কাজ করার। আমার মা-বাবার মতো সকল মা-বাবাই সন্তানের কাছে অমূল্য সম্পদ। আমার মা বাবা বেঁচে নেই, কিন্তু একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হলে অসংখ্য মা-বাবা চিকিৎসা পাবেন এবং তাদের মধ্যে আমি আমার মা-বাবা হারানোর বেদনা কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারবো।
সৌভাগ্যক্রমে এ সময় আমি কুমিল্লা জেলার জেলা প্রশাসক ছিলাম এবং তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. খন্দকার মুশাররফ হুসেন ছিলেন কুমিল্লা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। কুমিল্লা জেলাকে শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের আওতায় আনয়ন, শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং শহরের সৌন্দর্য্য বর্ধনের কারণে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা লাভ করায় মন্ত্রী মহোদয় আমাকে যথেস্থ পছন্দ করতেন। কয়েকবার কুমিল্লা সফরে এসে আমার কাজ কর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে জানতে পারি যে সরকার ২০ শয্যা বিশিষ্ট ২০টি হাসপাতাল নির্মাণ করার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমি বিলম্ব না করে মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে দাবি জানালাম যে, এই ২০টির মধ্যে আমার গ্রামে যেন একটি থাকে। তিনি কথা দিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০টি হাসপাতালের তালিকায় ৫ নাম্বারে জগদলের স্থান হল। এরপর টেন্ডার হল এবং কার্যাদেশও হল। মন্ত্রী মহোদয়ের অনুরোধে হুইপ জনাব ফজলুল হক আসপিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন।
উল্লেখ্য, ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে মাননীয় এমপি বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বিশেষ অতিথি হিসাবে আমি নিজে গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি।
অতঃপর তথাকথিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার এসে এই প্রকল্পের সরকারি অর্থ বরাদ্ধ প্রত্যাহার করে নিয়ে প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ করে। বিশ্বব্যাংক প্রকল্পে অর্থায়ন করতে নীতিগতভাবে রাজি হয় এবং হুকুম দখল প্রক্রিয়া ছাড়া জমি দানপূর্বক প্রকল্পটিতে জমির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে অনুরোধ করে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্বেচ্ছায় ৩ একর জমি প্রাপ্তি সম্ভব না হওয়ায় ২০টির মধ্যে অনেকগুলি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিচ্ছে মর্মে আমি অবগত হই। আমি দ্রæত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টরের সাথে দেখা করি ও আমার গ্রামে হাসপাতাল স্থাপনের যৌক্তিকতা তাঁকে ব্যাখ্যা করি। আমার মা-বাবার করুণ মৃত্যুর বৃত্তান্ত তার কাছে উপস্থাপন করলে তিনিও আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন। তখন নির্ধারিত সময় প্রায় শেষ। আমাকে তিন দিনের সময় দিয়ে ৩ দিনের মধ্যে ৩ একর জমির দলিল তার নিকট প্রদানের জন্য অনুরোধ করলেন এবং বলে দিলেন জমির দলিল যথাসময়ে দিতে পারলে জগদল হাসপাতাল হবে। আমি বিলম্ব না করে গ্রামের সংশ্লিষ্ট সকলকে দ্রæত দিরাই গিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দলিল আমার কাছে ২ দিনের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য তাগাদা দিই। একই সাথে আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে রেজিস্ট্রেশন খরচ ৫২ হাজার টাকা মওকুফ করিয়ে নিই।
সাব-রেজিস্ট্রারকে অনুরোধ করি তিনি যেন ঐদিনই জমি রেজিস্ট্রি এবং দলিলের নকল সরবরাহ করেন। জমিদাতাগন সকলে দিরাই আসেন এবং জমি রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন ও দলিলের নকল সংগ্রহ করে দুইজন রাতের বাসে ঢাকা রওয়ানা হন। নির্ধারিত শেষদিনে সকালে আমাকে দলিল দেয়া হলে আমি বেলা ১১টার মধ্যে দেখা করে কান্ট্রি ডিরেক্টরের হাতে দলিল অর্পণ করি। অতঃপর আবার টেন্ডার ও কার্যাদেশসহ নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। ঠিকাদারকে পরিস্কার ভাষায় বলে দিই যে, এই প্রকল্পে কোন প্রকার দুর্নীতি এবং কাজে গাফিলতি করা যাবে না এবং কাজে আমার জানামতে কোন দুর্নীতি বা গাফিলতি হয়নি বিধায় জগদলে একটি দৃষ্টিনন্দন হাসপাতাল জগদলের সকলের সহযোগিতায় আমি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি, যার তুলনা সিলেট বিভাগে বিরল।
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরপরই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়ে হাসপাতালটি উদ্বোধন করার ইচ্ছা জানালে আমি তাঁকে বলি জনবল ও সরঞ্জাম কাঠামো অনুমোদন করিয়ে এবং ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দিয়ে তবেই উদ্বোধন করুন। আমাকে তাতে না রাখলেও আমি সহযোগিতা করবো। তিনি আমার কথা না শুনে ঘটা করে এসে উদ্বোধন করলেন এবং বলে গেলেন ৬ মাসের মধ্যে সব হবে। ৬ মাস পেরিয়ে ৬ বছর চলছে, কিন্তু হাসপাতাল চালু না হওয়ায় জনগনের ভোগান্তি এখন চরমে। আমি দুই দফা উদ্যোগ নিলেও অদৃশ্য হস্তক্ষেপের কারণে সুনামগঞ্জের স্বাস্থ্য প্রশাসনের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাইনি।
যে কোন একটি প্রতিষ্ঠিত সম্পদ নষ্ট করা সহজ কিন্তু গড়া খুবই কঠিন কাজ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য থাকার পরেও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় আমাকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে। একটি বড় ধরনের প্রকল্প তৈরি থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত কাজ তুলে আনার জন্য বার বার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে হয়, দেখা করতে হয়, তাগাদা দিতে হয়, প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া জানতে ও বুঝতে হয়। কারণ, একটি প্রকল্প অনেকগুলি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে এবং সর্বোপরি কাজটি আদায়ের জন্য লেগে থাকতে হয়। আমি আমার প্রতিটি কাজ এভাবেই আদায় করেছি। অনেকে কথায় কথায় এই কাজ টেন্ডার হয়ে যাচ্ছে, ঔ কাজ দ্রæত অনুমোদন হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি বলে জনগণকে প্রায়শই আশ্বাস দিয়ে থাকেন, কিন্তু ফলাফল পাওয়া যায় না। কারণ, তারা প্রক্রিয়া জানেন না, লেগেও থাকেন না এবং শেষমেশ আমলাদেরকে দোষারোপ করে নিজে বাঁচার চেষ্টা করেন।
২০ শয্যার এই হাসপাতালে একজন ডাক্তার আর কিছু ঔষধ দিলেই চালু হবে না। এর জন্য ডাক্তার, নার্স, টেকনিক্যাল স্টাফ ও অন্যান্য জনবল কাঠামো (সর্বমোট ২১টি পদ) এবং শয্যাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কাঠামো অনুমোদন করতে হবে, অতঃপর তাদের নিয়োগ করতে হবে। প্রায় ৮ কোটি টাকায় নির্মিত এই হাসপাতালটি তাই কারো মুখের কথায় চালু হবে না। এটি চালু করতে হলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পরিশ্রম করার ইচ্ছা, যোগ্যতা ও সামর্থ্য।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগামিকাল ২০ ফেব্রæয়ারি শনিবার উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বহু কাক্সিক্ষত ২০ শয্যার জগদল হাসপাতালটি।)