বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন
হাফিয মাওলানা ড. সৈয়দ রেজওয়ান আহমদ:
কুরবানি হলো মুসলিম জাতির অন্যতন একটি ইবাদত যা প্রতি বছর নিদিষ্ট সময়ে বিত্তববানদের উপর আরোপিত হয় এবং মুসলিম উম্মাহ কুরবানি নামক ইবাদাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করে থাকে।
কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা। অর্থ্যাৎ নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে মহান আল্লাহ পাকের নামে জবেহ করাই হলো ‘কুরবানি’।
আদি পিতা আদম আ.-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের দেওয়া কুরবানি থেকেই কুরবানির ইতিহাস শুরু। তারপর থেকে সকল মুসলিম উম্মাহর উপর তা জারী হয়েছে। আমাদের উপর যে কুরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম আ. কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল আ.-কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহিমী’ হিসাবে চালু হয়েছে। সুন্নাতে ইবরাহিমী কুরবানির দিনকে ইয়াওমুন নাহর বা ঈদুল আজহা বলা হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষসহ পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে এ দিনটি কুরবানির ঈদের দিন হিসেবে পরিচিত।
যিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে এই ইবাদত পালন করতে হয়। পবিত্র কুরআন মজিদে কুরবানি সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’। (আল কুরআন; ২২ : ৩৬)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- হে নবি আপনি বলুন! আমি তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানি । আর এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’।(আল কুরআন; ৩৭ : ১০৭-১০৭)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানি কর’।(আল কুরআন; ১০৮ : ২)
কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় এবং মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানি করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানকে আল্লাহর জন্য সালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানি করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
এটি ইসলামের অন্যতম একটি ইবাদাত হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সা. নিজে মদীনা জীবনে প্রতি বছর কুরবানি আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানি আদায় করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু রয়েছে।
মানুষ কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হতে চায়। আল্লাহ তায়ালার জন্য মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করার বিশেষ একটি পরীক্ষা হলো কুরবানি। কুরবানি আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহীম আ. এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদেরকে এখন আর পুত্র (সন্তান) কুরবানি দেওয়ার মত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি হালাল পশু কুরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি।
মুসলিম জাতির জন্য আল্লাহর কাছে কুরবানীর দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চাইতে অধিকতর প্রিয় আর কিছুই নয়। কুরবানির রক্ত মাটি স্পর্শ করার পূর্বেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরবানিদাতাকে সাবধান করে দিয়েছেন, ‘কুরবানির পশুর রক্ত গোশত কোন কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে কেবল তোমাদের তাক্বওয়া’। (আল কুরআন; ২২: ৭) অর্থাৎ কুরবানিদাতা যেন আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই কুরবানি করে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ’। মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহীম আ. আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবি সা. আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। আর কুরবানির মূল আহবান হ’ল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা।
আল্লাহ তায়ালা কুরবানির মাধ্যমে আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য অর্জনে তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: প্রিন্সিপাল, সৈয়দপুর ফাযিল মাদরাসা।