রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২০ পূর্বাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ব্যাপারে র্যাবের কাছে মুখ খুলেছেন এই মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আনার সময় সাত খুনের বিষয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন নূর হোসেন। ঢাকায় ফেরার পথে র্যাবের গাড়িতে নূর হোসেন অনেক কথাই বলেছেন। তার কী কী পরিকল্পনা ছিল, কোথায় টাকা পেয়েছেন বা কে লাভবান হয়েছেন তাও বলেছেন। তার ওই সব কথাবার্তা রেকর্ড করে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে নূর হোসেনকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করার পরপরই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তাকে র্যাবের একটি গাড়িতে উঠানো হয়। ওই সময় তার চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। শরীর কাঁপছিল। তখন র্যাব কর্মকর্তারা তার কাছে জানতে চান, আপনি কাঁপছেন কেন? উত্তরে নূর হোসেন বলেন, স্যার আমার ভয় লাগছে। র্যাব কর্মকর্তারা তখন তাকে অভয় দিয়ে সত্য কথা বলতে বলেন। কথায় কথায় উঠে আসে সাত খুনের আদ্যোপান্ত। নূর হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়েই ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার বিরোধ বাধে। কাউন্সিলর নজরুল ইসলামই ছিল আমার প্রধান টার্গেট। তাকে দুনিয়া থেকে সরানোর জন্য যা যা করার দরকার ছিল সেই চেষ্টাই করেছি আমি। সে আমার অনেক ক্ষতি করেছে। রাজনৈতিকভাবেও সে আমাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে। এই কারণে তাকে মেরে ফেলতে র্যাব কর্মকর্তাদের সাথে চুক্তি করি। তারা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। পরে এক কোটি টাকায় তা চূড়ান্ত হয়। এই ঘটনার আগে র্যাব-১১ এর তৎকালীন সিও লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে তার অফিসে একাধিকবার দেখা হয়েছে। আর মেজর আরিফ আমার বাসায় এসে অগ্রিম ১০ লাখ টাকা নিয়ে যায়। সাত খুনের বিষয়ে র্যাবের প্রশ্নের জবাবে নূর হোসেন বলেন, আবারও বলছি, নজরুল ছিল আমার প্রধান শত্রু। তাকে মেরে ফেলার জন্যই আমি পরিকল্পনা করি। অন্য কাউকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল না আমার। তাকে হত্যা করতে প্রথমে র্যাবের মেজর আরিফের সাথে যোগাযোগ করি। আরিফের সঙ্গে আগে থেকেই আমার যোগাযোগ ছিল। তিনি সব সময় আমার আস্তানায় আসতেন। সেই সুবাদে তাকে বলি স্যার, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। কাউন্সিলর নজরুলকে মেরে ফেলতে হবে। তখন আরিফ বলেন, এতে আমাদের লাভ কী? তখন আমি বলি, আপনাদের অব্যশই খুশি করা হবে। আরিফ আমার সামনে সিও তারেক সাঈদ ও কমান্ডার রানাকে ফোন করেন। আরিফের কথামতো আমি সিও’র সঙ্গে তার দপ্তরে দেখা করি। সিওকে বলি, নজরুলকে মারতে পারলে আপনাদের এক কোটি টাকা দেওয়া হবে। পরে আরিফের কাছে দেওয়া হয় অগ্রিম ১০ লাখ টাকা। মেজর আরিফ আমাকে বলেন, নজরুলকে কিভাবে আমরা পাকড়াও করব? তখন আমি বলি, নজরুলের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা আছে। সে হাইকোর্ট-জজকোর্টসহ সব কোর্টেই আসা-যাওয়া করে। সে কখন আদালতে যাবে তা আপনাদের জানাব। নূর হোসেন বলেন, ২৭ এপ্রিল নজরুল আদালত থেকে বের হওয়ার পরপর আমি মেজর আরিফকে ফোন করি। তখন আরিফ বলেন, সব রেডি আছে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। পরে নজরুলকে অপহরণ করার পর আরিফ আমাকে বলেন, অপারেশন সফল হয়েছে। এখন তাকে মারার দায়িত্ব আমাদের। এ কথা শোনার পর আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। খুশির চোটে সিও সাহেবকে ফোন করে বলি স্যার, তাকে মেরে এমন জায়গায় রাখবেন কেউ যেন টের না পায়। এ সময় সিও সাহেব বলেছিলেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ওই সময় সিও বা মেজর আরিফ একটিবারের জন্য বলেননি নজরুলের সাথে অ্যাডভোকেট চন্দনসহ আরো ছয়জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এ কথা যদি আমি জানতাম তাহলে তাদের মারার জন্য নিষেধ করতাম। এক প্রশ্নের জবাবে নূর হোসেন বলেন, ২৭ এপ্রিল রাত ১২টা কিংবা সাড়ে ১২টার দিকে মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, নজরুলসহ সাতজনকে আমরা মেরে ফেলেছি। তখন আমি এর প্রতিবাদ করে বলি, আমার পরিকল্পনায় ছিল শুধু নজরুল। আপনেরা অন্যদের মারলেন কেন? এটা ঠিক করেননি। তখন আরিফ আমাকে বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের বাঁচিয়ে রাখলে সবার বিপদ হবে। এ কারণেই তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। সিও স্যারও বলেছেন সবাইকে মেরে ফেলতে। এখন এসব কথা বাদ দিয়ে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিয়ে দেন। সিও স্যারের সাথে কাল দেখা করবেন। নূর হোসেন বলেন, মেজর আরিফ আমাকে আশ্বস্ত করে বলেন, লাশ এমন স্থানে রাখা হবে কেউ জানতে পারবে না। তার কথা অনুযায়ী আমি ঘটনার পরের দিন সিও সাহেবের সাথে দেখা করে আসি। সিও আমাদের ভয় পেতে নিষেধ করেন। নূর হোসেন বলেন, লাশগুলো পানিতে ডুবিয়ে দেয়ার সময় আরিফ আমার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করে। তবে কমান্ডার রানা আমাকে ফোন দিতেন না। তার সাথে আমার তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না।সূত্র জানায়, সাত খুনের বিষয়ে নূর হোসেন আরও বলেন, এই ঘটনা নারায়ণগঞ্জ র্যাব অফিসের কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ জানত না। তবে নজরুলসহ অন্যদের অপহরণের বিষয়টি জানত এলাকার কিছু নেতাকর্মী। অ্যাডভোকেট চন্দন কুমারসহ ছয়জনকে হত্যা করার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন নূর হোসেন। তিনি বলেন, ওই ছয়জনের মৃত্যুর জন্য র্যাবের সাবেক কর্মকর্তারাই দায়ী। তারা অতি উৎসাহী হয়ে নিরপরাধ ছয়জনকে মেরে ফেলেছে। তাদের মেরে ফেলার আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তিনি বলেন, র্যাবের সিও তারেক সাঈদের সাথে অ্যাডভোকেট চন্দনের বিরোধ ছিল বলে আমি জানি। আর সে গোপনে ওই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে। নূর হোসেন জানান, হত্যাকা-ের কথা র্যাবের তখনকার সিও, মেজর আরিফ, কমান্ডার রানাসহ অপারেশনে যারা ছিলেন তারাই শুধু জানতেন। এর বাইরে কেউ জানত না।অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার রহস্য উন্মোচন করে নূর হোসেন বলেন, আমি পড়ালেখা জানি না। প্রথমে ট্রাক ড্রাইভার ছিলাম। পরে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমার কাছ থেকে এমন কোনো লোক নেই যারা টাকা-পয়সা নেয়নি। পুলিশ, র্যাব, রাজনৈতিক নেতা ও কয়েকজন সাংবাদিক নিয়মিত টাকা নিত। অনেকের বিয়ের বাজার পর্যন্ত করে দিয়েছি। সূত্র জানায়, গল্পের ছলে নূর হোসেনের কাছ থেকে এসব কথা আদায় করে র্যাব। কথাগুলো রেকর্ড করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের সময় নূর হোসেন খুব আতঙ্কে ছিলেন। তার ধারণা ছিল, বাংলাদেশে আসার পরপরই ক্রসফায়ারে মারা যাবেন। আর যখন বুঝতে পারেন তিনি আর মারা যাবেন না, তখনই তার মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। আদালতে ওঠানো এবং কারাগারে নেওয়ার সময় তার মুখে সেই হাসিই লেগে ছিল।