রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১২ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘রাজনীতির পাঠশালাখ্যাত’ সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে নিজদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত মরণ কামড় দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুসারীরা। এ আসনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৭ বার ও তার মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনসহ স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্তা ২ বার নির্বাচিত হয়েছেন। তবে স্বাধীনতার পর থেকে সেন পরিবারের দখলে থাকা এ আসনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হয়নি বলেই সচেতন মহল মনে করেন। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও এলাকার সাধারণ মানুষের তথ্য মতে, একই পরিবারের দখলে দীর্ঘদিন থাকার পরও যেহেতু দিরাই-শাল্লার কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি, তাই এবার পরিবর্তন করে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা এবার নৌকা প্রতীক না পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবেও উন্নয়নহীন অবস্থাকেই চিহ্নিত করেছেন সাধারণ ভোটার।
এদিকে ‘রাজনীতির পাঠশালাখ্যাত’ সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে আওয়ামী লীগ পরিবারের অন্যতম সদস্য হিসেবে দলীয় প্রতীক নৌকা পেয়েছেন শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (আল আমিন চৌধুরী)। ফলে হেভিয়েট দুই প্রার্থী মাঠে থাকায় সুনামগঞ্জ-২ আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনী লড়াই। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি কুশল বিনিময়, পথসভা, গণসংযোগ ও উঠান বৈঠকে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। নির্বাচনের ফলাফল নিজ নিজ পক্ষে আনতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন হেভিওয়েট দুই প্রার্থী। তারা দিচ্ছেন নানারকম প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনী এলাকার দু’উপজেলার রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজর, পাড়া-মহল্লা ও চায়ের দোকানে সাধারণ ভোটারদের মাঝে একই আলোচনা, কে হচ্ছেন পরবর্তী সংসদ সদস্য। যার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ লড়াইয়ের আশা করছেন সাধারণ ভোটাররা।
উপজেলা রিটার্নিং অফিস সূত্রে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে ৬ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (আল আমিন চৌধুরী), গণতন্ত্রীপার্টি মনোনীত প্রার্থী মিহির রঞ্জন দাস, স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব মোঃ মিজানুর রহমান, ড. শামসুল হক চৌধুরী ও ঋতেশ রঞ্জন দেব। তবে বাছাইয়ে মোঃ মিজানুর রহমান, ড. শামসুল হক চৌধুরী ও ঋতেশ রঞ্জন দেবের প্রার্থীতা বাতিল হলে আপিল করে শুধুমাত্র মোঃ মিজানুর রহমান তা ফিরে পান। আর দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঝামেলা থাকায় গণতন্ত্রী পার্টির দাখিলকৃত সকল মনোনয়ন বাতিল করা হলে সর্বশেষ আপিলের মাধ্যমে প্রার্থীতা ফিরে পেয়ে মাঠে গণসংযোগ করছেন কবুতর প্রতীকের মিহির রঞ্জন দাস।
‘রাজনীতির পাঠশালাখ্যাত’ সুনামগঞ্জ-২ আসনে রাজনীতির সমীকরণ সব সময়ই হয় ভিন্ন রূপে, এর ব্যতিক্রম ঘটছে না এবারও। রাজনীতির সুবিধাভোগী গ্রুপটি তাদের স্বার্থেই স্থানীয় আওয়ামী লীগে গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব লাগিয়েই রাখতে চায়। এ দ্বন্দ্বের অবসানে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও ফলাফল কিছুই আসেনি। বরং সুবিধাভোগীরা এবারও সক্রিয় ও তৎপর রয়েছে দলের ইমেজ নষ্ট করতে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নৌকা প্রতীক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে (আল আমিন চৌধুরী) দিলেও দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তার নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন। এতে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। এর প্রভাব ভোটের মাঠেও দৃশ্যমান রয়েছে।
সরেজমিন মাঠ ঘুরে ও ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একই দলের বর্তমান সংসদ সদস্য ও দল মনোনীত প্রার্থী হওয়ায় তারা অনেকটা বেকায়দায় রয়েছেন। যার কারণে প্রকাশ্যে ভোট প্রদানের কথা কেউই মুখ খোলে বলতে পারছেন না। তবে প্রত্যেক প্রার্থীকেই আশ্বাস দিয়ে বিদায় দিচ্ছেন তারা। বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তার সমর্থকরা এ প্রতিবেদককে জানান, সুনামগঞ্জ-২ আসনে আমাদের নিজস্ব (সংখ্যালঘু) প্রায় ৮৬ হাজার ভোট রয়েছে, সে ক্ষেত্রে বিজয়ের ব্যাপারে আমরা শতভাগ আশাবাদী রয়েছি। কোন অপশক্তি কিংবা কারচুপি না হলে আমাদের বিজয় কেউ আটকিয়ে রাখতে পারবে না। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নৌকা প্রতীকের সমর্থকেরা জানান, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে এ আসনে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত। আমরা ভোটারদের কাছে যাচ্ছি এবং নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছি।
বিশ্বস্ত কয়েকটি সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জ-২ আসনে একই দলে দুই প্রার্থী হওয়ায় ভোটের হিসাব-নিকাশে সমীকরণ চলছে। কাকে ছেড়ে কাকে ভোট দেবে ভোটাররা। তাছাড়া দেশব্যাপি বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। বিশেষত বিএনপি, অন্যান্য সমমনা দল ও ইসলামি দলগুলোর ভোটাররা এ নির্বাচনে ভোট দিতে আদৌ যাবেন কি না, তাতে ব্যাপক সংশয় রয়েছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
তবে স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আমাদের দলের অনেক ভোটার কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য, জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও দিরাই-শাল্লার সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরীর নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি যাকে ভোট দিতে বলবেন, আমরা তাকেই ভোট দেব। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দেশব্যাপি ভোট বর্জনের কারণে তিনি এ ঘোষণা আদৌ দিবেন কি না? আর যদি দলের ভোটাররা স্বপ্রণোদিত হয়ে ভোটে যায়, তবে এ ভোটগুলি ভাগাভাগি হয়ে পড়তে পাবে বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেন।
সুনামগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্রপ্রার্থী ড. জয়া সেনগুপ্তা জানান, নির্বাচনী এলাকার দু’উপজেলার গণসংযোগ শেষ পর্যায়ে, ভোটারদের আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি, জয়ের ব্যাপারে অবশ্যই আমি আশাবাদী।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (আল আমিন চৌধুরী) জানান, এ পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার সকল স্থানেই গণসংযোগ শেষ করেছি। আমার প্রতি ভোটারদের আগ্রহ যথেষ্ট রয়েছে। আমি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্রপ্রার্থী মোঃ মিজানুর রহমান জানান, আমার গণসংযোগ প্রায় শেষ, ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি, বিজয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।
গণতন্ত্রীপার্টি মনোনীত প্রার্থী কবুতর প্রতীকের মিহির রঞ্জন দাস বলেন, একটি আইনী জটিলতার কারণে আমি নির্বাচনী মাঠে আসতে দেরী হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন জটিলতায় আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে ২৭ ডিসেম্বর থেকে মাঠে আছি। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যেয়ে সাড়া পাচ্ছি, জয়-পরাজয় থাকবেই, তবে তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলেও জানান।