শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:১৪ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার :
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে প্রকাশিত `1001 Inventions : The Enduring Legacy of Muslim Civilization’ বইয়ের বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ‘মুসলিম সভ্যতায় ১০০১ আবিষ্কার’। এটি কেবল একটি বই নয়-এক আকাশ ইতিহাসের শেকড় সন্ধানী ইতিহাস সংকলন। হাজার বছরের ইহিতাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা মুসলিম সভ্যতার মহানয়ক মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানের ইতিহাস ভিত্তিক আলোচনাগুলো আবৃত হয়েছে দু’মলাটের ভেতরকার জমিনে।
গোটা বিশ্বের ইতিহাস থেকে মুসলিম সভ্যতার অবদান মুখর অধ্যায়কে মুছে ফেলে এবং সকল শিক্ষা পাঠ্যক্রম থেকে এ আলোচনা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে যে সময়টিকে ‘ডার্ক এইজ’ বা ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে, এ গ্রন্থে মূলত সে সময়টিকে ‘গোল্ডেন এইজ’ বা ‘স্বর্ণ যুগ’ প্রমাণ করা হয়েছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি এবং আবিষ্কার উন্নয়নের নেপথ্যে মুসলিমদের কৃতিত্ব ও অবদানমূলক গৌরব গাথাগুলো একত্রিত করা হয়েছে এ গ্রন্থের পাতায় পাতায়।
সাদা কাগজের কিছু পৃষ্ঠার ওপর ছবি ও লেখায় ভরপুর নিছক কোনো গ্রন্থ নয় এটি। মুসলিম সভ্যতার মহানায়ক মুসলিম বিজ্ঞানীদের গৌরব গাথা আবিষ্কার-অবদানের ইতিহাস সমৃদ্ধ শেকড় সন্ধানী এক প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘মুসলিম সভ্যতায় ১০০১ আবিষ্কার’।
শিরোনামের সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরে মূলত আজকের লেখার শুরু। পৃথিবী সৃষ্টির পর এর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে তাদেরকে যাবতীয় কাজের শিক্ষাও দিয়েছেন। বনি আদম তথা মানুষজনসহ কমবেশি আটারো হাজার মাখলুকাত এই জমিনে বসবাস করছে। তবে সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানুষকে। তাই যুগে যুগে মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে নানা পথ-পদ্ধতি ও যন্ত্র-প্রযুক্তির।
আখেরী নবীর উম্মতের মধ্যে এক সময় মুসলমানগণ শিক্ষা-সাহিত্য, চিকিৎসা-প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রেই জয়-জয়কার ছিলো। যাকে ইসলামের ইতিহাসে ‘স্বর্ণ যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই স্বর্ণ যুগ বা গোল্ডেন এইজের সময়ে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তারা যখন ভোগ-বিলাসিতার অন্ধ মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখনই বাতিল শক্তি বা অমুসলিমরা সুযোগ নিয়ে নেয়। আজকের প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়-জয়কারের তামাশা দেখলে মনে হয়, এগুলো শুধুমাত্র ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের দ্বারাই সম্ভব। অথচ, এগুলোর অধিকাংশই যে মুসলিমদের আবিষ্কার, তা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল।
আল্লাহপাক বলেন-অর্থাৎ তারা কি কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করে না, না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ। -সূরা মুহাম্মদ-২৪
আল্লামা ইকবাল বলেন-সাহাবা, তাবিঈন, তাবে তাবেয়ীন ও আয়াম্মায়ে মুজাহিদিনের জামানায় মুসলমানরা কুরআনের ঝাণ্ডা পতাকাবাহী হবার কারণে সারা দুনিয়ার মানুষ তাদেরকে ইজ্জত করেছে, আর এই জামানায় তোমরা কুরআনকে ছেড়ে দিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছো।
যেভাবে মুসলমানদের অধঃপতন শুরু :
মুসলমানদের রয়েছে সোনালি অতীত। মুসলমানরা শ্রেষ্ঠ জাতি, বীরের জাতি, বিজয়ী জাতি। এক সময় বিশ্বের বড় বড় সব পরাশক্তি মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও পরাজিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান জগতে মুসলমানদের দ্রুত অবনতি শুরু হয় ১৩৫০ সালের পর থেকে। মুসলমান শাসকদের একটি চরম ত্রুটি ছিল-তারা শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনো গুরুত্ব প্রদান করেন নি। স্কুল-মাদরাসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা অমুসলিম শাসকদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন। মুসলিম জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষ করে গড়ে তুলতে যে পরিমাণ গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক ছিল, তার সামান্যও তারা দেননি।
বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের অনেক অবদান। বিশেষত বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়ে মুসলমানদের ছিল সবচেয়ে বেশি অবদান। মুসলমান বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, ইসলাম পরিপূর্ণভাবে পালন করার জন্য এ তিনটি শাখার উপর জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। শাখা তিনটি হচ্ছে মহাকাশ, গণিত ও চিকিৎসা বিজ্ঞান।
মহাকাশ বিজ্ঞানের প্রয়োজনে চাঁদ এবং সূর্যের হিসাব নিকাশ বুঝতে হবে। যেহেতু চাঁদের হিসাবটা বিশেষ দিন এবং বিশেষ মাস বের করা প্রয়োজন। আর সূর্যের হিসাবটা নামাযের ওয়াক্ত এবং অন্যান্য বিশেষ ওয়াক্ত বের করার জন্য প্রয়োজন। আর গণিতটা প্রয়োজন গণিত ছাড়াতো মহাকাশ বিজ্ঞান চিন্তাই করা যায় না। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করাও সুন্নত। ব্যবসা-বাণিজ্যর জন্য হিসাব করতে গণিত লাগে। আবার ফারায়েজের মাসয়ালা অর্থাৎ সম্পত্তি বন্টনের জন্যও গণিত প্রয়োজন। আবার মহান আল্লাহপাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন, ‘নামায শেষ হওয়ার পর তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পর’। কোথাও যেতে হলে ম্যাপের দরকার। ম্যাপটা হলো ভূগোলের অংশ আর ভূগোলটা জ্যামিতির অংশ, জ্যামিতিও ওই গণিতের অংশ। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানটা প্রয়োজন, কারণ চিকিৎসা করা সুন্নাত।
এছাড়াও মহাকাশ বিজ্ঞান যেহেতু পদার্থ বিজ্ঞানের একটি অংশ, সেহেতু মুসলমানরা মহাকাশ বিজ্ঞানটা শেখার জন্য পদার্থ বিজ্ঞানটাও চর্চা করতেন। আবার যেহেতু চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে রসায়ন একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেহেতু মুসলমানরা চিকিৎসা বিজ্ঞানটা শেখার জন্য রসায়নটাও চর্চা করতেন। যার কারণে এ পাঁচটা বিজ্ঞানের শাখার মধ্যে মুসলমানদের অনেক বেশি অবদান ছিল। এ পাঁচটা বিজ্ঞানের শাখার ইতিহাস পড়লেই এগুলো জানা যাবে।
যে সকল শাখায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান :
আধুনিক বিশ্ব গড়ার যে সকল উপাদান প্রয়োজন, কিংবা একটি প্রযুক্তি নির্ভর সুন্দর পৃথিবী গড়তে যা যা দরকার, তার সবই এসেছে এককালের মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাত ধরে। আজকের বিজ্ঞানের জয়-জয়কার আর প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মূল কারিগর ছিলেন আমাদের পূর্বসূরি মুসলিম পণ্ডিত-বিদ্বান ও বিজ্ঞানীগণ। তারা যে সকল শাখায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, তা হলো রসায়ন, পরমাণু, বীজগণিত, পদার্থ, আলোকবিদ্যা, ভূমির তফসিল ও জরিপ, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, পাঠের উপযোগী ল্যান্স, চিকিৎসা, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, ভৌগলিক মানচিত্র, সার্জারী, স্বাস্থ্যবিধি, ফার্মাকোলজি, স্থাপত্য, ভাষা বিজ্ঞান, নেভিগেশন ডিভাইস, কম্পাস, টেলিস্কোপ ইত্যাদি।
জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৪) :
রসায়ন বিজ্ঞানের উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন জাবির ইবনে হাইয়ান। তাকে রসায়ন বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তিনি ৮ম শতকের বিজ্ঞানী। তিনি পরমাণুকেও বিভক্ত করা যেতে পারে, এ ধারণা প্রদান করেন এবং তা প্রমাণ করতে সক্ষম হোন। ইউরোপীয়দের আবিষ্কারের এক হাজার বছর পূর্বে তিনি এগুলো উদ্ভাবন করেন। তিনি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানাগারের ধারণার প্রবর্তক পরিমাপ ও পরীক্ষার উদ্ভাবক।
মুসা আল-খাওয়ারিজমী (৭৮০-৮৫০) :
বীজগণিতর আবিষ্কারক আল খারেজমি। প্রাচীন ও ভারতীয়দের গণিতকে ব্যাখ্যা করেন তিনি। যখন গণিতকে পর্যালোচনা করলেন, তখন দেখতে পেলেন যে, তারা ত্রিভূজ ও কিছু নকশার মাধ্যমে তাদের গাণিতিক সমস্যাকে সমাধান করে থাকেন। কারণ তাদের কাছে কোনো ধারণা ছিল না। গাণিতিক বর্ণমালার মাধ্যমে প্রকাশ করে আজকের এই বীজগণিতের ধারণা প্রবর্তন করেন। খারেজমি এছাড়াও দ্বিঘাত-ত্রিঘাত, সমীকরণসহ ঘনমূলকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়, তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন। বিশ^বাসী যে শূন্য (০) ব্যবহার করে, তার ধারণাও মুসলিমরা উদ্ভাবন করেন।
উনাকে অবশ্য মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গণিতবীদ হিসেবে ধরা হয়। এই আধুনিক বীজ গণিত যেটা, এটা উনিই আবিস্কার করে দিয়ে গেছেন। মূসা ইবনে খারিজমী যে বইটা লিখেছিলেন সেটা হচ্ছে, ‘কিতাবুল জাবির ওয়াল মুকারাবা’। যেমন বীজ গণিতের মধ্যে ‘পাওয়ার’-এর যে সিস্টেমটা; এটাও মুসলমানদেরই আবিস্কার। আবু কামিল নামে একজন মুসলমান গণিতবিদ ছিলেন, উনি এটা প্রথম চালু করেন পাওয়ার, রুট এগুলোর সিস্টেম। তারপরে অংকের যে যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ, এই চিহ্নগুলোও মুসলমানদেরই দেয়া। এই চিহ্নগুলো আবিস্কার করেছিলেন আবুল হাসান ইবনে আলী কালাসাদি।
মুসলিম মনীষা গ্রন্থের মতে, মুহম্মদ মুসা আল খারিজমির বীজগণিত প্রাঞ্জল ও সরল ভঙ্গিতে লেখা, তাতে প্রায় ৮০০ ধরণের উদাহরণ দেয়া আছে। তিনি একত্রীকরণ ও দুই ডিগ্রির সমীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করে তার হরণ ও পূরক সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন। সমীকরণকে সমাধান করার প্রায় ছয়টি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করেন। লগারিদমের সকল সূত্র আবিষ্কার করেন আল হারজেম। পদার্থ বিজ্ঞানের জনক ইবনে হায়সাম। পরমাণু ও অণু সর্বপ্রথম ধারণা তিনি প্রদান করেছিলেন। তিনি আলোর প্রতিসরণ আবিষ্কার করেন।
আব্বাস আবনে ফিরনাস (৮১০-৮৮৭) :
আব্বাস ইবনে ফিরনাস ছিলেন বার্বার বংশদ্ভূত আন্দালুসিয় মুসলিম পলিম্যাথ বা বহুশাস্ত্র বিশারদ। তার আসল নাম আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি। তিনি ছিলেন একজন আবিষ্কারক, প্রকৌশলী, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, আরবী সাহিত্যের কবি এবং আন্দালুসিয় সুরকার। তিনি আন্দালুসের ইযন-রেন্ড ওন্ডায় (বর্তমান স্পেনের রন্ডা) জন্মগ্রহণ করেন এবং কর্ডোবা আমিরাতে বসবাস করতেন। উড্ডয়নের প্রচেষ্টার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত। চাঁদে ইবনে ফিরনাস গহ্বরটি ইবনে ফিরনাসের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ইবনে ফিরনাস আল-মাকাতা নামক জল ঘড়ির নকশা করেন। এছাড়াও তিনি স্বচ্ছ কাচ নির্মাণের জন্য যন্ত্রের নকশাও প্রণয়ন করেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য প্ল্যানিস্ফিয়ার নামক যন্ত্র ও পাঠের উপযোগী লেন্স প্রস্তুত করেন। গ্রহ নক্ষত্রের ঘূর্ণন প্রদর্শনের জন্য কার্যকর মডেলও তিনি প্রস্তুত করেন। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল পাথরের স্ফটিককে কাটার প্রক্রিয়া।
আল-বাত্তানী ইসমাইলি (৮৮৫-৯২৯) :
শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হলেন আল-বাত্তানী ইসমাইলি। তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। আল-বাত্তানী পূর্বে মিশরীয় বিজ্ঞানী বাতলামাউস মহাকাশে সূর্য প্রদক্ষিণ সম্পর্কে ধারণা পেশ করেন। কিন্তু বাত্তানী এ কথাকে ভুল প্রমাণিত করে বলেন যে, ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট ২২ সেকেন্ড লাগে অর্থাৎ ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৬ মিনিট ২২ সেকেন্ডে এক বছর। আল-বাত্তানী আমাদের সামনে যে হিসাব পেশ করছেন, আজকের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে হিসাব বের করা হয়েছে, তার সাথে মাত্র ২ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের পার্থক্য।
ইবনে সিনা (৮৯০-১০৩৭) :
অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যে স্বর্ণযুগ চলছিল, তার অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব, শ্রেষ্ঠতম মুসলিম বিজ্ঞান প্রতিভা ছিলেন ইবনে সিনা। প্রধানত চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত ইবনে সিনা মূলত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, ন্যায়শাস্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তুলনাহীন প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। রাষ্ট্রতত্ত্বেও ইবনে সিনা ছিলেন অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মধ্যে সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেন। রাজ পরিবারের সদস্য হয়েও ধন-সম্পদ, ভোগ-বিলাস এবং ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের মোহ বর্জন করে তিনি জ্ঞান সাধনাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে তিনি আল-মাজসুয়া নামক একখানা বিশ্বকোষ রচনা করেন।
আল-বিরুনী (৯৩৭-১০৪৮) :
আবু রায়হান আল-বেরুনী বা আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ আল-বেরুনী। সাধারণত আল-বেরুনী নামে পরিচিত। ইসলামী স্বর্ণযুগে একজন খাওয়ারেজমিয় ইরানি পণ্ডিত এবং বহুবিদ্যা বিশারদ ছিলেন। তাকে বিভিন্নভাবে ‘ইন্ডোলজির প্রতিষ্ঠাতা’, ‘তুলনামূলক ধর্মের জনক’, ‘আধুনিক জিওডেসির জনক’ এবং প্রথম নৃতত্ত্ববিদ বলা হয়। তিনি অত্যন্ত মৌলিক ও গভীর চিন্তধারার অধিকারী ছিলেন। শহরের বাইরে বসবাস করতেন বলে সাধারণভাবে তিনি আল-বেরুনী নামে পরিচিত। রুশীয় তুর্কিস্তানের খিওয়ায় এটি অবস্থিত ছিলো। শহরটি খাওয়ারিজিমের রাজধানীর কাছে ছিলো। বর্তমানে শহরটি নদীতে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এখন এ স্থানটি আল-বেরুনী শহর নামে অভিহিত।
তিনি ছিলেন গণিত, জ্যোতি পদার্থবিদ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী। অধিকন্তু ভূগোলবিদ, ঐতিহাসিক, পঞ্জিকাবিদ, দার্শনিক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাষা তত্ত্ববিদ ও ধর্মতত্ত্বের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক। স্বাধীন চিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, সাহসিকতা, নির্ভীক সমালোচক ও সঠিক মতামতের জন্য যুগ শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত।
ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১) :
গিয়াসউদিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি। একজন ইরানের কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। ইরানের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করার পর যুবা বয়সে তিনি সমরখন্দে চলে যান এবং সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর বুখারায় নিজেকে মধ্যযুগের একজন প্রধান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার বীজগণিতের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন। এই পদ্ধতিতে একটি পরাবৃত্তকে বৃত্তের ছেদক বানিয়ে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করা হয়। ইসলামি বর্ষপঞ্জি সংস্কারেও তার অবদান রয়েছে।
ইবনে যুহর (১৯১-১১৬১) :
আবু মারওয়ান আব্দুল মালিক বিন যুহর ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আরব চিকিৎসক, সার্জন এবং কবি। ঐতিহ্যগতভাবে তিনি লাতিন নামে অ্যাভেনজোয়ার, আবুমেরন, আভুমেরন, আলোমেরন দ্বারা অধিক পরিচিত। তিনি মধ্যযুগীয় আন্দালুসিয়ার (বর্তমান স্পেন) সেভিলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইবনে রুশদ ও ইবনে তুফাইলের সম-সাময়িক এবং তিনি তাঁর যুগের সবচেয়ে সুপরিচিত চিকিৎসক ছিলেন। বিশেষ করে ওষুধের ক্ষেত্রে তিনি আরো যুক্তিযুক্ত ও অত্যাধুনিক অভিজ্ঞতামূলক ভিত্তি আবিষ্কারের উপর জোর দেওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন। তার প্রধান কাজ হলো, আল-তাইসির ফিল-মুদাওয়াত ওয়াল-তাদবীর বুক অফ সিম্পলিফিকেশন কনসার্নিং থেরাপিউটিকস অ্যান্ড ডায়েট, যা লাতিন এবং হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ইবনে যুহর অস্ত্রোপচারের অগ্রগতিতে অন্তত প্রভাবশালী ছিলেন।
ইবনে আল-বাইতর (১১৯৭-১২৪৮) :
জিয়া উদ্দিন আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বিন আহমদ আল-মালিকী, যিনি ইবনুল বিতার, আল-নাবাতি ও আল-আশব নামেও পরিচিত ছিলেন একজন মুসলিম উদ্ভিদবিদ, যিনি ইসলামের স্বর্ণযুগে আবির্ভূত সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের একজন হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি ছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও ওষুধে তার সময়ের বিজ্ঞানী, ওষুধ তৈরিতে প্রথম ফার্মাসিস্ট ও কেমোথেরাপির পথ-প্রদর্শক। তিনি আন্দালুসিয়ার মালাগা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন এবং আবুল আব্বাস ইবনে আল-রুমিয়াহ আল-নাবাতি ও আবদুল্লাহ বিন সালেহ আল-কুতামির মত পণ্ডিতদের হাতে সেভিলে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিশ বছর বয়সে পৌঁছানোর পরে মরক্কোতে চলে যান এবং উদ্ভিদবিদ্যার একজন গবেষণাকারী হিসাবে মারাকেশ, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া যান। তারপরে তিনি এশিয়া মাইনরে লেভান্টের মধ্য দিয়ে যান এবং সেখান থেকে হিজাজ, গাজা, জেরুজালেম, বৈরুত ও মিশরে যান।
ইবনুল বিতার অনেকগুলি রচনা লিখেছেন; যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল বোটানিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া। যেখানে তিনি এক হাজার ৪ শতকেরও বেশি উদ্ভিদ, প্রাণী ও খনিজ ওষুধের বর্ণনা করেছেন, যাদের মধ্যে ৩০০টি ছিল তার নিজের তৈরি করা।
ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) :
অতীতের ইতিহাস ছিল উপন্যাস নির্ভর। ইবনে খালদুন হলেন সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক, যিনি ইতিহাসকে উপন্যাস ধারা থেকে বের করে নিয়ে আসেন। কারণ তিনি মনে করতেন, ইতিহাস কোনো উপন্যাস হতে পারে না। ইতিহাস হলো সকল মানুষ ও জাতির পতন ও বসবাস করার কাহিনী বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে এটি একটি জ্ঞানের অন্যতম শাখা হতে পারে। এই ধারণা থেকে তিনি পুস্তক রচনা করেন, ইতিহাস তত্ত্বের ব্যাখ্যা এবং ভৌগোলিক মানচিত্র আবিষ্কার করেন। ইবনে খালদুনকে আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বলা হয়।
আল-জাবির ওয়াল-মুকাবিলা :
বীজগণিতের উপর লেখা তাঁর বইটি সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত। এই বইটির নাম অনুসারে এলজেবরা বা বীজগণিত নামকরণ করা হয়। এ বইটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় দ্বাদশ শতকে। অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়ে এই নতুন বিজ্ঞান পশ্চিমা জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়। এর আগে ইউরোপের কাছে বীজগণিত ছিলো একটি অচেনা বিষয়। ইউরোপীয়রা এ বিষয়ে ছিলো পুরোপুরি অজ্ঞ।
গিয়াস উদ্দিন জামশেদ :
গিয়াস উদ্দিন জামশেদ তার গ্রন্থ রিসালাতুল মুহিতিয়ে সর্বপ্রথম সাইনাসের হিসাব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। সাইন এক ডিগ্রির ধারণাকে এমনভাবে তুলে ধরেন যে, কমার পরে ১১টি সংখ্যাকে তিনি সাইন এক ডিগ্রিকে গণনা করতে পেরেছেন। ইলেক্ট্রনিক ক্যাকুলেটরে একই মান পাওয়া যায়। বর্তমান হিসাব নিকাশও তাই বলে। মুসলিমরা শুধু জ্যোতির্বিদ্যা আবিষ্কার করেনি। আজকের বীজগণিতের আবিষ্কারক হলেন মুসলিমগণ।
খালাফ আবুল-কাসিম আল-জাহরাভি :
খালাফ আবুল-কাসিম আল-জাহরাভি একাদশ শতাব্দীর একজন অত্যন্ত বিখ্যাত সার্জন ছিলেন, যিনি ইউরোপে তাঁর কাজের জন্য পরিচিত, কনসেসিও (কিতাব আল-তাসরিফ)।
আল্লামা কামাল উদ্দিন দামেরী (৮০৮) :
বিজ্ঞান জগতে এক অমোচনীয় নাম হচ্ছে আল্লামা কামাল উদ্দিন দামেরী রাহ.। তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে আজকের প্রাণিজগত। অবাক হলেও সত্য যে, বর্তমান যুগে যে সকল প্রাণিজগতের চিত্র আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে, তার একচ্ছত্র অবদান বিজ্ঞানী আল্লামা কামাল উদ্দিন দামেরীর। তাঁর লেখা ‘হায়াতুল হায়ওয়ান’ প্রাণি জগতের এক ও অদ্বিতীয় গ্রন্থ। বইটিতে তিনি প্রাণির নাম, জাত ও এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর এই বইটির অনুকরণে আজকের নেট দুনিয়ায় সাগরের নিচে, জঙ্গলের ভেতরে কিংবা আকাশে উড়ন্ত প্রাণিদের সম্পর্কে আমরা অবগত হচ্ছি।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের স্বর্ণযুগ :
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদানের ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। অতীতে বিশ্বের কোন জাতিই এমন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। কিন্তু আমরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলে যেতে বসেছি। ফলে সাম্প্রতিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খুব একটা দক্ষতা ও সফলতার পরিচয় দিতে পারছি না আমরা। বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদের দিকে তাকালে যে চিত্রটি দেখতে পাই, ঠিক তার উল্টো আলোকিত যুগ পার করে এসেছে মুসলিমরা। এই যুগ ইতিহাসে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলে পরিচিত। ইসলামি স্বর্ণযুগ অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার সময়কালকে বোঝায়, যা ৬২২ সালে মদিনায় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী শক্তির উত্থানের সময় থেকে শুরু হয়।
বায়তুল হিকমাহ :
সে সময় জ্যোর্তিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, জীববিদ্যা, চিকিৎসা, দর্শন ও অর্থনীতিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল অঙ্গনে মুসলমানদের একচ্ছত্র বিচরণ ছিল। ইসলামের স্বর্ণযুগ উত্থানের পিছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা ছিল পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর। ইসলামের স্বর্ণযুগ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদের (৭৮৬-৮০৯) সময় বাগদাদে বাইতুল হিকমাহর প্রতিষ্ঠার ফলে জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বায়তুল হিকমাকে প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফাতেমীয় যুগে (৯০৯-১১৭১) মিশর সম্রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই যুগে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভা ছিল বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও শিক্ষার মূল কেন্দ্র। আরবরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিল।
জ্যোতির্বিদ্যা :
মুসলমানদের সব সময় জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। প্রত্যেক মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে চাঁদ ও সূর্যের গুরুত্ব অপরিসীম। চাঁদ দ্বারা মুসলমানরা তাদের চন্দ্র ক্যালেন্ডারে মাসের শুরু এবং শেষ নির্ধারণ করে। সূর্য দ্বারা মুসলমানরা নামাজ ও রোজার সময় গণনা করে। এটাও জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমে মুসলমানরা কিবলার সুনির্দিষ্ট দিক নির্ধারণ করতে পারে, মক্কায় কাবার দিকে মুখ করে নামাজের সময়। সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট সৌর ক্যালেন্ডার, জুলিয়ানের চেয়ে উচ্চতর, হল জিলালি, উমর খৈয়ামের তত্ত্বাবধানে প্রণীত। কুরআনে জ্যোতির্বিদ্যার অনেক উল্লেখ রয়েছে। ‘আকাশ ও পৃথিবী সঠিকভাবে আদেশ করা হয়েছিল এবং সূর্য, চন্দ্র, তারা এবং দিন ও রাতসহ মানুষের অধীনস্থ করা হয়েছিল। প্রতিটি স্বর্গীয় দেহ আল্লাহর দ্বারা নির্ধারিত একটি কক্ষপথে চলে এবং কখনই বিচ্যুত হয় না, যার ফলে মহাবিশ্ব একটি সুশৃঙ্খল, যার জীবন এবং অস্তিত্ব, হ্রাস এবং প্রসারণ সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার দ্বারা নির্ধারিত’। -কোরআন ৩০:২২
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই প্রথম মান মন্দির স্থাপন করেছিলেন। যেমনটি পারস্যের চেঙ্গিস খানের ছেলে হুলাগু দ্বারা মুগারাতে নির্মিত হয়েছিল এবং তারা চতুর্ভূজ এবং জ্যোতির্বিদ্যার মতো যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, যা কেবল জ্যোতির্বিদ্যায় নয়, মহাসাগরীয় নেভিগেশনেও অগ্রগতির দিকে পরিচালিত করেছিল।
ভূগোল :
মুসলিম পণ্ডিতরা ভূগোলের প্রতি খুব মনোযোগ দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, ভূগোলের প্রতি মুসলমানদের বড় উদ্বেগের উৎপত্তি তাদের ধর্ম থেকেই। কুরআন মানুষকে সর্বত্র আল্লাহর নিদর্শন ও নিদর্শন দেখতে সারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করতে উৎসাহিত করে। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানের কিবলার দিক (মক্কায় কাবাঘরের অবস্থান) জানার জন্য ভূগোল সম্পর্কে অন্তত যথেষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। মুসলমানরা বাণিজ্য পরিচালনার পাশাপাশি হজ্ব করতে এবং তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য দীর্ঘ ভ্রমণে অভ্যস্ত ছিল। ভূগোলের ক্ষেত্রে, এমনকি পাশ্চাত্যেও সবচেয়ে বিখ্যাত নামগুলির মধ্যে রয়েছে ইবনে খালদুন এবং ইবনে বতুতা, যারা তাদের বিস্তৃত অনুসন্ধানের লিখিত বিবরণের জন্য বিখ্যাত। ১১৬৬ সালে আল-ইদ্রিসি, সুপরিচিত মুসলিম পণ্ডিত যিনি সিসিলিয়ান আদালতে সেবা করেছিলেন। সমস্ত মহাদেশ এবং তাদের পাহাড়, নদী এবং বিখ্যাত শহরগুলির সাথে একটি বিশ্ব মানচিত্রসহ খুব সঠিক মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। আল-মুকদিশিই প্রথম ভূগোলবিদ, যিনি রঙে সঠিক মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। অধিকন্তু, মুসলিম ন্যাভিগেটর এবং তাদের উদ্ভাবনের সাহায্যে ম্যাগেলান কেপ অফ গুড হোপ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল এবং দা গামা এবং কলম্বাস তাদের জাহাজে মুসলিম ন্যাভিগেটর ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তারা প্রথম ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মডেল ছিল, যেমন বোলোগনা, হাইডেলবার্গ এবং সোরবোন। এমনকি পরিচিত একাডেমিক ক্যাপ এবং গাউনের উৎপত্তি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মুসলিমরা ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, ফার্মাকোলজি, স্থাপত্য, ভাষাবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে। বীজগণিত এবং আরবি সংখ্যা মুসলিম পণ্ডিতদের দ্বারা বিশ্বের কাছে চালু করা হয়েছিল। জ্যোতির্বিদ্যা, চতুর্ভূজ এবং অন্যান্য নেভিগেশন ডিভাইস এবং মানচিত্র মুসলিম পণ্ডিতদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল এবং বিশ্বের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, বিশেষত ইউরোপের অন্বেষণের যুগে। মুসলিম পণ্ডিতরা গ্রীস এবং রোম থেকে চীন এবং ভারত পর্যন্ত প্রাচীন সভ্যতাগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন।
মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ :
একবিংশ শতাব্দীর মানুষের ধারণা ও বিশ্বাস যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান নেই। এ বিশ্বাস ও চেতনা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অন্যান্য ধর্ম ও জাতির তুলনায় অনেক বেশি। ইসলামের সূচনা থেকেই শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের যাত্রা হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যযুগের মুসলমানরা আপন হৃদয়ের জ্ঞানরূপ আলোক বর্তিকা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেন। পৃথিবীর সব জ্ঞান আহরণ করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। খলিফা মনসুর, হারুন অর-রশিদ, মালিক শাহ ও মামুনের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা চরমে পৌঁছেছিল। বাগদাদ, মিসর, মরক্কো, স্পেন, পারস্য, সিসিলি, গ্রানাডা প্রভৃতি স্থান ছিল সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অংক, বিজ্ঞান, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, সামরিক শিক্ষা, তফসির, হাদিস, ফেকাহ, শিল্পকলা, নৌবিদ্যা, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি শিক্ষা লাভের প্রাণকেন্দ্র।
রসায়ন শাস্ত্রকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণা থেকে উদ্ধার করে পরিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে উন্নত করতে মুসলিম বৈজ্ঞানিক জাবির ইবনে হাইয়ানের রয়েছে অভূতপূর্ব অবদান। তিনি ২ হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে ২৬৭ খানা রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে রচিত। মধ্যযুগে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গভীর সাধনা করেন ইবনে সিনা, ইবনে জাহর, আল জাহরাওয়ী, উবায়দুল্লা জেব্রিল, আলী ইবনে সহল রব্বান আল-তাবায়ী, আল রাজী, আলী বিন-আব্বাস ও আল মজসী। চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে ইবনে সিনার লিখিত গ্রস্থ ‘আল কানুন’কে চিকিৎসা শাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়। আরববাসীর মধ্যে গণিতশাস্ত্রে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন খোয়ারীজমি ও ইবনে মুল্লাহ। খোয়ারীজমির লিখিত ‘হিসাবুল জবর ওয়াল মু কাবল’ গ্রন্থটি সর্বপ্রথম বীজ গণিতের পাঠ্যপুস্তক রূপে সমাদৃত হয়। পৃথিবী যে গোল, তাও তিনি ১১৮৬ সালে তার রচিত ‘সুরাত আল আরদ্ধ’ নামক গ্রন্থ দ্বারা প্রমাণ করে দেখান। তাছাড়া ইবনে মুসা একধারে গণিতবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোর্তিবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। ৮৫০ সালে তিনিই প্রথম মানচিত্রের ব্যবহার দেখান।
নৌ-সংক্রান্ত কম্পাস আবিষ্কার করে মধ্যযুগের মুসলমানরা সমুদ্রযাত্রা করে বিভিন্ন দেশ আবিষ্কার করেন। আব্দুর রহমান, জায়হানী, আল ইদ্রিসী, আল বকরী, খুরদেচ্ছি, আল মামুদী, হাওকল আল-মুকদ্দসী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভূগোলজ্ঞ ছিলেন। আরবি নাবিক আব্দুর রহমানের নির্দেশে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। বৈজ্ঞানিক আবুল হাসান টিউব থেকে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ ও ইবনে বয়তার মুসলিম স্পেনে উদ্ভিদ বিদ্যায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন। আল-মাজিরিত, আল জারকালি ইবনে আফলাহ মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম ও আল ফাজারি সে যুগের প্রসিদ্ধ জ্যোর্তিবিদ ছিলেন। ১০৬৮ সালে স্পেনের সঈদ আসসাফি একটি আন্টোলের তৈরি করেন, যা দ্বারা বছরে সূর্যের গতিপথ নির্দেশিত এবং ২৮টি তারকার অবস্থান বোঝা যায়। বর্তমানে এটা অক্সফোর্ডের মিউজিয়াম অব হিস্ট্রি অব সায়েন্সে সুরক্ষিত আছে।
প্রতিকার :
সবদিক বিবেচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপের নবজাগরণই হচ্ছে মধ্যযুগের মুসলিম মনীষীদের ৭০০ বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার অমৃত ফল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম মানব সভ্যতাকে উন্নত শিখরে পৌঁছে দিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আজ মুসলমানরা দাওয়াত ও তাবলীগ ছেড়ে দিয়েছে। ফলে তারা সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও আদর্শিক চেতনার অভাবে স্বাধীন মানুষ ও স্বাধীন জাতির মর্যাদা হতে বঞ্চিত। কারণ, মুসলিম মনীষীরা বিজ্ঞানের উৎকর্ষে যে অবদান রেখেছেন, তা ভুললে আজকের বিজ্ঞানের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। তবে বর্তমান মুসলমানদেরও অবশ্যই তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পূর্বসূরী মনীষীদের দেখানো পথে হাঁটতে হবে।
তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন অনলাইন জার্নাল।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক, লেখক-গবেষক, গ্রন্থ প্রণেতা।