শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৯:২২ অপরাহ্ন
আজ থেকে ৭৩ বছর আগে ১৩৫৮ বাংলার ৮ই ফাল্গুন আজকের এই দিনে যে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বাংলা ভাষার অধিকার পেয়েছিলাম, তা জাতি সংঘের মাধ্যমে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে আমাদের বাংলা ভাষাকে সম্মানিত করেছে।
মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষ যে ধ্বনি ব্যবহার করে তা হলো ভাষা। আর নিজেদের মায়েরা যে ভাষায় কথা বলে তা মাতৃভাষা। মাতৃভাষা ছাড়া মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। মাতৃভাষা আল্লাহ তায়ালার অপার নেয়ামত। মাতৃভাষা চর্চা বা বিশুদ্ধভাবে কথা বলা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অনুপম সুন্নত। যেসব গুণ মানুষের ব্যক্তিত্বকে অর্থবহ এবং প্রশংসনীয় করে তোলে, তার মধ্যে বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ অন্যতম।
পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের বেশি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। সবার ভাষা এক নয়। জাতি ও মানচিত্র ভেদে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলে। বিচিত্র এসব ভাষায় বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ কথা বলে। এ ভাষাগুলোই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের মাতৃভাষা। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖ خَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافُ اَلۡسِنَتِكُمۡ وَ اَلۡوَانِكُمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّلۡعٰلِمِیۡنَ ﴿۲۲﴾
‘আর তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে’। -সুরা রুম : আয়াত ২২
কুরআনে মাতৃভাষার গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৎপথ দেখানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূলকে পাঠিয়েছেন। তাঁদের উপর যেসব আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছিল, সেগুলোর ভাষা ছিল ওই নবী-রাসূলদের স্বজাতির ভাষা। নবী-রাসুলদের কাছে পাঠানো আসমানি কিতাবসমূহ মাতৃভাষায় অবতীর্ণ না হলে সেগুলো তাঁদের জাতি ও সম্প্রদায় বুঝতে পারত না। ফলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত। মাতৃভাষার সঙ্গে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি জড়িত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهٖ لِیُبَیِّنَ لَهُمۡ ؕ فَیُضِلُّ اللّٰهُ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَهۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَكِیۡمُ ﴿۴﴾
‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য’। -সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪
হযরত ঈসা আ.-এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সুরিয়ানি, তাই সুরিয়ানি ভাষায় তাঁর প্রতি ইনজিল অবতীর্ণ হয়। হযরত মুসা আ.-এর জাতির ভাষা ছিল ইবরানি, তাই ইবরানি ভাষায় তাওরাত অবতীর্ণ হয়। হযরত দাউদ আ.-এর জাতির ভাষা ছিল ইউনানি, তাই ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় জাবুর অবতীর্ণ হয়। আর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর আগমনাঞ্চলের ভাষা ছিল আরবি, তাঁর প্রথম ও প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিলেন আরবরা। তাই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কুরআনুল কারিম আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। আসমানি কিতাবসমূহ যদি নবী-রাসূলদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় না হয়ে ভিন্ন ভাষায় নাজিল হতো, তাহলে নিজেদের উম্মতদেরকে দীনের আলোর দিকে আহ্বান করা নবী-রাসূলদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যেত।
রাসূলুল্লাহ সা. আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন ভাষা ও সাহিত্যে সর্বাধিক নৈপুণ্যের অধিকারী, আরবের সবচেয়ে স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ ভাষী। তাঁর বাচন ভঙ্গি, মাতৃভাষায় বিশুদ্ধতা এবং উচ্চারণের সুস্পষ্টতা ছিল রাসূল চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষী’।
তাঁর মাতৃভাষা আরবি হওয়ায় মুসলমানদের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থ কুরআনুল কারিম আল্লাহ তায়ালা আরবি ভাষায় নাজিল করেছেন। যেন ভ্রান্ত লোকেরা সহজেই তাওহিদ বা একত্ববাদ স্বীকার করে ইসলামি জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এবং কিতাবপ্রাপ্ত নবী-রাসূলরা সহজেই দীনের দাওয়াত দিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَاِنَّمَا یَسَّرۡنٰهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الۡمُتَّقِیۡنَ وَ تُنۡذِرَ بِهٖ قَوۡمًا لُّدًّا ﴿۹۷﴾
‘এরপর আমি এ কুরআনকে আপনার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি। যাতে মুত্তাকিদেরকে এর (বেহেশতের) সুসংবাদ দিতে পারেন, আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (দোজখের) ভয় দেখাতে পারেন’। -সুরা মারিয়াম : আয়াত ৯৭।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
اِنۡ حِسَابُهُمۡ اِلَّا عَلٰی رَبِّیۡ لَوۡ تَشۡعُرُوۡنَ ﴿۱۱۳﴾ۚ وَ مَاۤ اَنَا بِطَارِدِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۱۴﴾ۚ اِنۡ اَنَا اِلَّا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۱۵﴾ؕ
‘এটা রুহুল আমিন জিবরাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তঃকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। যাতে ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারেন’। -সুরা শুয়ারা, আয়াত ১১৩-১১৫
এসব আসমানি কিতাব মাতৃভাষায় নাজিল না হলে এগুলো নাজিলের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতো। কারণ আসমানি কিতাব নাজিলের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, পূণ্য অর্জনের জন্য এর মর্ম অনুধাবন করা এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এর আলোকে জীবন ব্যবস্থা কায়েম করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَ لَوۡ جَعَلۡنٰهُ قُرۡاٰنًا اَعۡجَمِیًّا لَّقَالُوۡا لَوۡ لَا فُصِّلَتۡ اٰیٰتُهٗ ؕ ءَؔاَعۡجَمِیٌّ وَّ عَرَبِیٌّ ؕ قُلۡ هُوَ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا هُدًی وَّ شِفَآءٌ ؕ وَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ فِیۡۤ اٰذَانِهِمۡ وَقۡرٌ وَّ هُوَ عَلَیۡهِمۡ عَمًی ؕ اُولٰٓئِكَ یُنَادَوۡنَ مِنۡ مَّكَانٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿۴۴﴾
‘আর যদি আমি কুরআন অনারবদের ভাষায় নাজিল করতাম তবে অবশ্যই বলতো, এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়নি কেন? এটা কেমন কথা, অনারবি কিতাব আর আরবি ভাষী রাসুল! আপনি বলুন, এই কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত স্বরূপ এবং ব্যাধির প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না, তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্ব স্বরূপ’। -সুরা হা মিম সাজদা : আয়াত ৪৪।
আল্লাহ তায়ালা অন্য একটি আয়াতে বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ قُرۡءٰنًا عَرَبِیًّا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲﴾
‘আমি তো কুরআন আরবিতে নাজিল করেছি এজন্য যে, তোমরা তা বুঝবে’। -সুরা ইউসুফ : আয়াত ২
হযরত মুসা আ. ফেরাউনের কাছে আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ পৌঁছে দেওয়ার পূর্বে আবেদন করেছিলেন,
وَ احۡلُلۡ عُقۡدَۃً مِّنۡ لِّسَانِیۡ ﴿ۙ۲۷﴾ یَفۡقَهُوۡا قَوۡلِیۡ ﴿۪۲۸﴾
‘হে আমার প্রভু! আমার জিহ্বা থেকে জড়তার সমাধান করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’। -সুরা ত্বহা : আয়াত ২৭-২৮
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِكَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۳۱﴾
‘হযরত আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সব কিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন’। -সূরা বাকারা : ৩১
আল্লাহ বলেন,
اَلرَّحۡمٰنُ ۙ﴿۱﴾ عَلَّمَ الۡقُرۡاٰنَ ؕ﴿۲﴾ خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ ۙ﴿۳﴾ عَلَّمَهُ الۡبَیَانَ ﴿۴﴾
‘করুণাময় আল্লাহ! শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানব প্রাণ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বয়ান’। -সুরা : আর-রাহমান, আয়াত : ১-৪
আল্লাহ বলেন,
اِقۡرَاۡ وَ رَبُّكَ الۡاَكۡرَمُ ۙ﴿۳﴾ الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ ۙ﴿۴﴾
‘পড়ো, তোমার রব মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন’। -সুরা : আলাক, আয়াত : ৩-৪
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,
اِنۡ حِسَابُهُمۡ اِلَّا عَلٰی رَبِّیۡ لَوۡ تَشۡعُرُوۡنَ ﴿۱۱۳﴾ۚ وَ مَاۤ اَنَا بِطَارِدِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۱۴﴾ۚ اِنۡ اَنَا اِلَّا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۱۵﴾ؕ
‘এটা রুহুল আমিন জিবরাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তঃকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। যাতে সতর্ককারী হতে পারেন’। -সুরা শুয়ারা: ১১৩-১১৫
আল্লাহ তায়ালা অন্য একটি আয়াতে বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ قُرۡءٰنًا عَرَبِیًّا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲﴾
‘আমি তো কুরআন আরবিতে নাজিল করেছি এজন্য যে, তোমরা তা বুঝবে’। -সুরা ইউসুফ: ২
হাদিসে মাতৃভাষার গুরুত্ব
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন।’ হযরত আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধ ভাষী; কুরাইশ গোত্রে আমার জন্ম’। হযরত আবু জর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন’। -মুসনাদে আহমাদ
তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিছু কথা জাদুময়’। -বুখারি শরিফ
রাসূলুল্লাহ সা. নিজে যেমন ভাষার প্রতি যত্নবান ছিলেন, তেমনি অন্যদেরও যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি কাউকে শব্দের ভুল প্রয়োগ বা ভাষার বিকৃতি করতে দেখলে তা শুধরে দিতেন। একবার এক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে বললেন, ‘আ-আলিজু’। শব্দটির অর্থ ‘আমি কি প্রবেশ করব?’ আরবি ভাষায় এ অর্থে ব্যবহৃত হলেও তা অনুমতি প্রার্থনার জন্য যথেষ্ট নয়। তখন রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর গোলামকে বললেন, বাইরে গিয়ে তাকে একথা বলতে বলো, ‘আসসালামু আলাইকুম! আ-আদখুলু?’ কারণ সে সুন্দরভাবে অনুমতি প্রার্থনা করেনি। -আল-আদাবুল মুফরাদ
ইমাম মুসলিম রাহ. তাঁর সহি মুসলিমে ‘আল-আলফাজু মিনাল আদাব’ শিরোনামে অধ্যায় এনেছেন। সেখানে উপযুক্ত শব্দচয়ন সম্পর্কে হাদিস আনা হয়েছে। এ অধ্যায়ের হাদিসগুলোতে রাসূলুল্লাহ সা. ভুল শব্দ প্রয়োগের সংশোধনী এনেছেন এভাবে- ‘আঙ্গুর’কে ‘কারম’ বলো না ‘ইনাব’ কিংবা ‘হাবালাহ’ বলো। কাউকে ‘দাস’ না বলে ‘চাকর’ বলো, কারণ সবাই আল্লাহর দাস ও দাসী; মনিবকে ‘প্রভু’ বলো না ‘সরদার’ বলো।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের ভাষার রয়েছে এক রক্তমাখা ইতিহাস। তাই শুদ্ধ বাংলা শেখা ও শেখানো এবং বলায়-লেখায় শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন। কারণ, শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারও রাসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নাত।
নিজ মাতৃভাষা সম্পর্কে গর্ব করে মহানবী সা. বলতেন, ‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুললিত। তোমাদের চেয়েও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুললিত’। -আল-মুজামুল কাবির : ৬/৩৫
এর কারণ তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্রে আমি মানুষ হয়েছি। তাদের কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাই আমি সর্বাধিক সুললিত ভাষা আত্মস্থ করেছি। -আল-বদরুল মুনির ফি তাখরীজিল আহাদিস : ৮/২৮১
আল-কুরআন কুরাইশদের ভাষা ও উচ্চারণ রীতি অনুসারে অবতীর্ণ হয়, কিন্তু ইসলাম ভাষাগত আঞ্চলিকতা তথা মাতৃভাষার প্রতি এতই গুরুত্ব দিয়েছে যে আরবের বিভিন্ন পঠন রীতিতে কুরআন পাঠ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কুরআন পাঠে ‘সাত কিরআত’ (পঠন রীতি) প্রচলিত আছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূল সা. বলেছেন, নিশ্চয়ই কুরআন সাত হরফে বা উপভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব, এসব ভাষার মধ্যে যে ভাষাটি (তোমাদের কাছে) সহজ হয়, সে ভাষায়ই তোমরা তা পাঠ করো’। -বুখারি, হাদিস : ৪৭৫৪
রাসূল সা. জায়েদ ইবনে সাবেত রা.-কে ইহুদিদের ইবরানি ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পৃথিবীতে ঠিক কতগুলো ভাষা আছে, তা অনুমান করা খুব কঠিন। তবে ধারণা প্রসূত বলা যায় এর সংখ্যা প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার। ইথনোলোগ (Ethnolgue) নামের ভাষা বিশ্বকোষের ২০১৯ সালে প্রকাশিত ১৬তম সংস্করণের হিসেব মতে জীবিত ভাষার সংখ্যা প্রায় ৬৯০৯। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৭৩৩০ ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে এবং অপশক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ জীবনের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন কিংবা বিমাতা সূলভ আচরণ এ দেশের আলেম সমাজের জন্য জাতি হত্যারই নামান্তর। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি মাদরাসায় বাধ্যতামূলক সাহিত্য-সাংবাদিকতার ওপর পাঠদান এখন সময়ের দাবি।
বাংলা সনের জন্ম হয় সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৎকালীন মহাপণ্ডিত ‘আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী’ বাংলা সনের উদ্ভাবন করেন। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল একটি পক্ষ। যারা বাংলা ভাষায় কথা বলত তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। জনগণকে ভীতি প্রদর্শন করত যে, ‘ভাষাং মানবঃ স্রোতা বৌরবং নরকং ব্রজ্রে’ অর্থাৎ- সংস্কৃতি ভাষা ছাড়া যারা অন্য ভাষা তথা বাংলা ভাষায় কথা বলবে, তাদের বৌরব নামক নরকে নিক্ষেপ করা হবে। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, ইতরের ভাষা বলে বাংলা ভাষাকে পণ্ডিতরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন। প্রকৃত অর্থে এই জনপদে বসবাসরত প্রত্যেক মানব সন্তানই এর উত্তরাধিকারী। বাংলা ভাষা এই পাললিক ভূমির আপমর জনতার ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফল স্বরূপ বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলন কারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভা যাত্রা সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাতারাতি ছাত্ররা গড়ে তুলে শহীদ মিনার, ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি সেই রক্তস্নাত গৌরবের সুর বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মানুষের প্রাণে অনুরণিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর এই দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আজ সারা বিশ্বের সকল নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকারের জন্য প্রাণ দেয় দেশের নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র আমরাই মাতৃভাষার জন্য রক্ত ও জীবন দিয়েছি। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের ‘ভাষা শহীদ দিবস’ এবং বর্তমানে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।
গ্রন্থনায়-
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার
সাঙবাদিক, লেখক, গবেষক, গ্রন্থ প্রণেতা।
তারিখ : ২১-০২-২০২৫