সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৪৯ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেক্স : দ্বিতীয় ধাপে ইউপি নির্বাচনের ভোটেও ব্যাপক ভোট জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল নিয়ে সংঘর্ষ-সহিংসতায় প্রাণহানি এবং প্রতিপক্ষের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় আজ সন্দ্বীপ, কেরানীগঞ্জ, যশোর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ ও জামালপুরে ৮ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর আগেও প্রথম ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি এবং বিভিন্ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ-সহিংসতায় অন্তত ২৮ জনের প্রাণহানি এবং ভোট বর্জনের ঘটনা ঘটেছিল।
আমাদের মাদারীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সদর উপজেলায় ভোট গণনার সময় ব্যালট পেপার ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে সুজন মৃধা (২৫) নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলায় দক্ষিণ রীরঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। সদর থানার ওসি জিয়াউল মোরশেদ জানান, সদর উপজেলায় দক্ষিণ রীরঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গণনা চলচিল। এ সময় সুজন মৃধা ব্যালট পেপার ছিনতাই করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছুড়লে তিনি মারা যান। লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় নোমেছা বেগম (৫০) নামে এক নারী নিহত হয়েছে। নিহত নারী ইমান আলীর স্ত্রী বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে ৬ নং ওয়ার্ডের বিজয়ী মেম্বার প্রার্থী পরাজিত প্রার্থী শিপন শেখের সমর্থক ইমান আলীর বাড়িতে হামলা করে। এ সময় লাঠির আঘাতে নোমেছা বেগমের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। দৌলতপুর থানার (ওসি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আইনুন নিশাদ বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার চর বাউরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ সদস্যসহ ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহতরা হলেন সানাউল্লাহ, ইব্রাহিম ও কামাল। বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সদ্বীপের বাউরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জিল্লুর রহমান দুপুরে তার আনারস প্রতীকে প্রকাশ্য ভোট দেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর চেয়ারম্যান প্রার্থী জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সদস্য প্রার্থী কে এই ভোট কারচুপিতে থাকবেন, তা নিয়ে সদস্য প্রার্থী সাহেব আলী ও বেলাল উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে পুলিশ এসে সংঘর্ষ থামাতে ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই জামাল ও ইব্রাহিম নিহত হন। আর সদ্বীপ ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান সানাউল্লাহ। নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্বরত চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ওয়াহিদুল হক বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী কেরাণীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ক্যাডারদের হামলা ও গুলিতে শাহিদুল ইসলাম শুভ (১০) নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এই ঘটনায় আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন। নিহত শাহিদুল ইসলাম ওই এলাকার ঢালিকান্দি গ্রামের আলাল মোল্লার ছেলে। স্থানীয়রা জানান, আজ সকাল পৌনে ১০ দিকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী আয়নালের ক্যাডার রানা মোল্লার নেতৃত্বে ২০ থেকে ৩০ জন অস্ত্রধারী কেন্দ্রে হামলা চালায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সকাল থেকে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ চলছিল। হঠাৎ ১০টার দিকে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর ক্যাডাররা কেন্দ্রে হামলা চালায়। এসময় তারা ১০ থেকে ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে স্থানীয় আলাল মোল্লার এক শিশু পূত্রসহ মোট ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শিশু শাহিদুল ইসলামকে স্থানীয় মডার্ণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুটির অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফার করা হয়। ঢাকায় নেয়ার পথে শিশুটি মারা যায়। বাকী আহতরা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। গোলাগুলির পর ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। পরে সংবাদ পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে বিজিবি উপস্থিত হয়। এসময় সন্ত্রসীরা পালিয়ে যায়। বর্তমানে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাৎক্ষণিকভাবে ভোটাররা আতঙ্কে ভোট কেন্দ্র ছেড়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলে অর্ধশতাধিক পুলিশ-বিজিবি ও র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
যশোরের চাঁচড়ায় ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল ও জালভোটকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের নাম পরিচয় জানা যায়নি। এছাড়া, যশোরের চুড়ামনকাঠিতে জাল ভোট দিতে সহায়তার অভিযোগে এক কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে আটক করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলার বরুড়ার খোশবাস ইউনিয়নে আরিফপুর কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় গুলিতে বিএনপি প্রার্থী জাকির হোসেন গুরুতর আহত হন। আজ ভোটগ্রহণের শুরুতেই আওয়ামীলীগের লোকজন কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করলে বিএনপি সমর্থকরা বাধা দেয়। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। যেকোনো মুহূর্তে আবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। এ সময় সেখান থেকে ৪জনকে আটক করা হয়েছে। কুমিল্লার আড্ডায় একটি কেন্দ্রের পাশ থেকে ককটেলসহ ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে। কুষ্টিয়ায় ইউপি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পার না হতেই ভোট স্থগিত করা হয়েছে। আজ সকালে দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের আড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়। তবে কিছুক্ষণ পরে ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ আবার শুরু হয়েছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউপি নির্বাচন বর্জন করেছেন বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল মতিন তোতা। সকাল সোয়া ৯টায় নির্বাচনে জাল ভোট প্রদান ও অনিয়মের অভিযোগ এসে তিনি সাংবাদিকদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত জানান।
এছাড়া মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার কুনতিপাড়া কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ-বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত আটজন আহত হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। আজ সকাল ৮টায় দ্বিতীয় দফার ভোট শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই এ সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং স্বাভাবিক ভোটগ্রহণ চলতে থাকে ।
জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে মেলান্দহ উপজেলার নয়ানগর ইউনিয়নের মামা-ভাগ্নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাময়িক ভোটগ্রহণ বন্ধ রয়েছে। জানা গেছে, ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই মেলান্দহ উপজেলার ওই কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের সহযোগিতায় জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পুলিশ ৩ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এর ফলে ওই কেন্দ্রে সাময়িক ভোটগ্রহণ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে চাঁদপুরের হাইমচরের একটি কেন্দ্রে ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এসময় আওযামীলীগ এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। চাঁদপুরের গাজীপুর, ঝিনাইদহের যাদবপুরে বিএনপি প্রার্থী এবং জামালপুরের ফুলকোচায় স্বতন্ত্রপ্রার্থী ভোট বর্জন করেছেন।
এদিকে ভোট গ্রহণ শুরুর আগের রাতে ভোলা সদরের রাজাপুর গ্রামে আওয়ামীলীগ সমর্থিত ও বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন।
আমাদের জামালপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ইউপি নির্বাচন শেষ হয়েছে। এ সময় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, সংঘর্ষ ও গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতের নাম রফিকুল ইসলাম (৫০)।
মেলান্দহ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের উত্তর বালুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সংরক্ষিত মহিলা মেম্বর প্রার্থী মর্জিনা বেগম (মাইক প্রতীক) এর সমর্থকদের সঙ্গে মেম্বার প্রার্থী ওয়াহেদ আলী ( টিউবওয়েল প্রতীক)-এর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রতিপক্ষের নিক্ষেপ করা ইটের আঘাতে রফিকুল ইসলাম মারা যান। তবে মেলান্দহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসিমুল ইসলাম দাবি করেছেন, রফিকুল ইসলাম হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।
নয়া নগর ইউনিয়নের মামা-ভাগিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী শফিউল আলমের সমর্থকরা ব্যালট পেপার ছিনতাই করে ছিল মারার চেষ্টা করলে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী এমদাদুল হকের সমর্থকরা তাতে বাধা দেয়। এ সময় তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষ থামাতে পুলিশ ৬ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। পরে কেন্দ্রটির নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়। এই ইউনিয়নের মালঞ্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর সমর্থকরা ব্যালট পেপার ছিনতাই করতে গেলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় সেলিম (৩০) নামে এক যুবক আহত হন। পরে পুলিশ ৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে । অন্যদিকে আদ্রা ইউনিয়নের আব্দুল মান্নান উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুজন মেম্বর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। পরে কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে মেলান্দহ উপজেলার ইউএনও জন কেনেডি জাম্বিল কেন্দ্র দুটি বন্ধ করার সত্যতা স্বীকার করেন।
অপরদিকে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপির তিন চেয়ারম্যান প্রার্থী আদ্রা ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর আলম, মাহমুদপুর ইউনিয়নের নূরে আলম তালুকদার রুনু এবং নাংলা ইউনিয়নের নূরুল হক জঙ্গী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। মেলান্দহে মোট ১০টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়েছে। অপর ১টি ইউনিয়নের নির্বাচন মামলার কারণে স্থগিত রয়েছে। অপরদিকে জামালপুর সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এসব ইউনিয়নে কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
সূত্র : শীর্ষ নিউজ