রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৬ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
প্রতিনিধি আবশ্যক: অনলাইন পত্রিকা আমার সুরমা ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হবে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন : ০১৭১৮-৬৮১২৮১, ০১৭৯৮-৬৭৬৩০১
দিরাইয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রকে আসামী করে উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি মামলা

দিরাইয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রকে আসামী করে উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি মামলা

মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার: এক হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে দল ত্যাগ করে আওয়ামীলীগে যোগদানের পর এখন তিনটি হত্যা মামলার আসামী হলেন দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ হাফিজুর রহমান তালুকদার। বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ার ক্ষোভে বিএনপিতে মনোনয়ন নিশ্চিত করেই দলে যোগদান করেন। এরপর তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দাপটের সঙ্গে পরিষদ পরিচালনা করলেও দিরাইয়ের ধলকুতুব গ্রামের একটি হত্যা মামলার ঘটনায় তাকে আসামী করা হলে প্রাণ বাঁচাতে আবারো আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের মধ্যে গত মঙ্গলবারে সংঘটিত জলমহাল দখল নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে এক সংঘর্ষে তিনজন নিহত হলে গতকাল (বৃহস্পতিবার) দিরাই থানায় উভয়পক্ষ মামলা দায়ের করে। এতে যুবলীগ নেতা একরার হোসেনের পক্ষের লোকজন বাদী হয়ে করা মামলায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ হাফিজুর রহমান তালুকদার, দিরাই পৌসভার মেয়র মোঃ মোশাররফ মিয়া ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়সহ ৩৯ জনকে আসামী করা হয়। অপরদিকে জলমহালের ইজারাদার পক্ষ দক্ষিণ নাগেরগাঁও মৎস্যজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ধনঞ্জয় দাস বাদী হয়ে উপজেলা যুবলীগ নেতা একরার হোসেনসহ ২৯ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে জলমহাল দখল নিয়ে আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী দুইপক্ষের বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিরীহ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের গোড়ামারা সাতপাখিয়া প্রকাশিত জারলিয়া নদী জলমহালের আশপাশের দুটি গ্রাম আকিলনগর ও হাতিয়ায় চলছে শোকের মাতম। ঘটনার দুইদিন পর জলমহালের ইজারাদার পক্ষ দক্ষিণ নাগেরগাঁও মৎস্যজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ধনঞ্জয় দাস বাদী হয়ে উপজেলা যুবলীগ নেতা একরার হোসেনসহ ২৯ জনকে আসামী করে এবং একরার হোসেন বাদী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান তালুকদার, পৌরসভার মেয়র মোঃ মোশাররফ মিয়া, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়সহ ৩৯ জনকে আসামী করে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
এলাকাবাসী ও পুলিশ সুত্রে জানা যায়, দিরাই উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে হাওরের দুর্গম এলাকায় জারলিয়া নদী জলমহাল। এই জলমহালটির কাগজপত্রে মালিকানা দক্ষিণ নাগেরগাঁও মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি হলেও এর শাসন ও দখল নিয়ে গত ৩ বছর ধরেই স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা মাসুক মিয়াসহ কয়েকজন ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা একরার হোসেনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। গত ৩ বছরে কয়েক দফায় এই জলমহালে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকাল ১১টায় একরার হোসেনের নেতৃত্বে ঐ জলমহাল দখলে একদল লোক যেতে চাইলে জলমহালের দখলদার ইজারাদার পক্ষ বাঁধা দিলে দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গোলাগুলির সময় ৩ নিরীহ ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। স্থানীয় লোকজন জানান, দুইপক্ষই সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় বিরোধ লেগেই আছে। এই বিরোধের জের ধরেই এমন হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
জলমহাল পাড়ের আনন্দনগরের বাসিন্দা রবিন্দ্র দাস বলেন, ‘মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ করেই গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি পূর্বদিক দিয়ে একরার হোসেনসহ বেশ কিছু লোক পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ি অতিক্রম করার পর অপরদিক থেকে জলমহালের ইজারদারপক্ষের ১০/১২ জন অস্ত্রসহ পাড়ে ওঠার পরই গোলাগুলি শুরু হয়। কয়েকটি গুলি আমাদের ঘরের চালে ও বেড়ায় এসে লাগায় আমরা দৌঁড়ে হাওরের দিকে পালাই।’ হাতিয়া গ্রামের নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘ইজারদার পক্ষ আনন্দনগর এলাকায় মাছ ধরছিল, এ সময় একরার হোসেনসহ কিছু লোক বাঁধা দিতেই গোলাগুলি শুরু হয়।’ তিনি জানান, ঘটনার সময় ইজারাদারের পক্ষে অস্ত্র নিয়ে গোলাগুলি করার সময় মাসুক মিয়া, আহাদ মিয়া, ইয়াহিয়া চৌধুরীসহ মাথায় হেলমেট পড়া ১০/১২ জন ছিল।
সূত্র আরো জানায়, নিহত উজ্জ্বল মিয়ার স্ত্রী ও নিহত শাহরুলের মা বিলাপ করে কান্নাকাটি করে বলছেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ, আমরাতো জলমহাল দখলে যেতে চাইনি, আমরা মালিকও হতে চাইনা, আমাদের জান গেল কেন, আমরা এখন কী নিয়ে বাঁচবো।’ নিহত দুই পরিবারই বলেন, ‘ইজারাদার পক্ষ ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী কাওছার, আঙ্গুরসহ অনেককে দিয়ে গুলি করিয়ে তাদের হত্যা করিয়েছে।’
বিরোধে যুক্ত যুবলীগের দিরাই উপজেলা কমিটির প্রস্তাবিত সহ-সভাপতি একরার হোসেনকে এলাকায় পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে একরার হোসেন ঘটনার জন্য দিরাই উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা ও দিরাই পৌরসভার মেয়র মোঃ মোশাররফ মিয়া, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায়কে দায়ী করে বলেন, ‘এই জলমহালটি ৩ বছর আগে দক্ষিণ নাগেরগাঁও মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি উমেশ দাস আমাকে সাবলিজ দিয়েছিলেন। পরে সমিতির কমিটি পরিবর্তন হওয়ার পর ধনঞ্জয় দাস অন্য পক্ষকে দিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করেছেন। এই সংঘর্ষ ও ঝামেলার জন্য দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান তালুকদার, পৌরসভার মেয়র মোঃ মোশাররফ মিয়া ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় দায়ী। এর আগে গত দুই বছর তারা আমাদের ডিস্ট্রাব করেছিলেন। পরে সেনবাবু (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) মধ্যস্ততা করে দিয়েছিলেন।’
ইজারাদার পক্ষের কুলঞ্জ গ্রামের ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, ‘মঙ্গলবারের গোলাগুলিসহ এখানে ৪ বার ঝামেলা হয়েছে। আমি মাসুক মিয়া, আহাদ মিয়া আমরা জলমহালে যাইনি, সংঘর্ষের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ঘটনা ঘটে যায়।’
দিরাই পৌরসভার মেয়র মোঃ মোশাররফ মিয়া ও প্রদীপ রায়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অসত্য এবং এ ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মতিউর রহমানের নাম যুক্ত করা ঠিক নয় মন্তব্য করে বলেন, ‘এই জলমহালে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে এমন আশঙ্কা থাকায় একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ২৭ ডিসেম্বর উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আমি কথা বলেছি।’
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ বলেন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য জলমহালে পুলিশ মোতায়েন করেছি। ঘটনায় জড়িত ছাড়া অন্য কাউকে হয়রানি করা হবেনা। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঐ এলাকায় থাকা বন্দুকসহ অস্ত্রসস্ত্র পুলিশ জব্দ করবে। দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আব্দুল জলিল বলেন, উভয়পক্ষ মামলা দিয়েছে। আসামী গ্রেফতার করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে, পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017-2019 AmarSurma.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com